মহাকাশ নিয়ে অনেক ভুল ধারণা থাকে আমাদের। তার মধ্যে অন্যতম হলো রাতের আকাশের তারার সংখ্যা। যদি প্রশ্ন করা হয় রাতের আকাশে যে তারা গুলো দেখতে পাই তার সংখ্যা হাতে গোনা যাবে কিনা তাহলে বেশিরভাগ সময়েই উত্তর আসে, যাবে না। কারণ তারার সংখ্যা অগুনতি। শকুন্তলা দেবী নাকি একমাত্র মানুষ যিনি এটা গুনতে পেরেছিলেন। আসলে এইসব কটাই আরবান মিথ। রাতের আকাশে যা তারা দেখা যায়, তা অবশ্যই হাতে কর গুনে বলা যায় আর তার জন্য শকুন্তলা দেবী হতে হয় না।
আসলে পৃথিবী থেকে আমরা যে রাতের আকাশ দেখি তাতে চাঁদ আর কিছু গ্রহ, কৃত্রিম উপগ্রহ আর উল্কা জাতীয় মহাজাগতিক বস্তু ছাড়া সবই সূর্যের মতন নক্ষত্র। নক্ষত্র আর তারা ব্যাপারটা বিজ্ঞানের কাছে একই, ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞান (প্রাচীনের কথা বলা হচ্ছে, বর্তমানের ধাপ্পা জ্যোতিষ না) অনুযায়ী একটু আলাদা। তো অনেক আলোকবর্ষ দূরে থাকার জন্য এদের প্রত্যেকেকই একটা বিন্দুর মতন লাগে পৃথিবী থেকে। কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখতে পাবেন সব তারার ঔজ্বল্য এক রকম লাগে না, রংয়ের তারতম্য ও দেখা যায়। রংয়ের ব্যাপারে পরে আসছি আগে ঔজ্বল্য নিয়ে বলি।
তারার ঔজ্বল্য মাপার জন্য বিজ্ঞানের কাছে একটা স্কেল আছে। স্কেলটা স্কুলের রোল নম্বরের মতন কাজ করে আর স্কেলটাতে প্রতি পাঁচ মাত্রার পরিবর্তন বাস্তবে তারার ঔজ্বল্যএ একশো ভাগ পরিবর্তন আনে। সোজা বাংলায় বললে এক মাত্রা বিশিষ্ট তারা ছয় মাত্রা বিশিষ্ট তারার থেকে প্রায় একশো গুন বেশি উজ্জ্বল হবে।
মানুষের দৃষ্টিশক্তির পরিমাপ মানে মানুষের খালি চোখ খুব বেশি হলে যেখানে লাইট পলিউশন নেই সেখানে পাঁচ মাত্রার বেশি তারার ঔজ্বল্য পরিমাপ করতে পারে না, শহরাঞ্চলে তিন। পৃথিবীতে অবস্থিত টেলিস্কপের লিমিট পনেরোর আশেপাশে। হাবল স্পেস টেলিসকোপের লিমিট সাতাশ। মোটামুটি ত্রিশ মাত্রাকে শুন্য ধরা হয় থাকে।
তো এই স্কেলে সূর্যের ঔজ্বল্য -27। পূর্ণিমার চাঁদ -12।
তো শহরাঞ্চলে মানুষের লিমিট মানে তিন মাত্রা অবধি তারা আছে মাত্র তিনশো টা, তাও গোটা পৃথিবী জুড়ে। উত্তর গোলার্ধে সংখ্যাটা অর্ধেক হবে। তাই কোনো এক সন্ধ্যেয় তারা গোনা যেতেই পারে। ব্যাপারটা অসংখ্য তো নয়ই, আর অসম্ভব ও না।
আরেকটা মজার তথ্য দিই, ধ্রুবতারা কিন্তু আকাশের সব থেকে উজ্জ্বল তারা না। লিস্টের আটচল্লিশ নম্বর তারা হলো ধ্রুবতারা। তাই আগে থেকে না চিনলে প্লিজ যাকে তাকে ধ্রুবতারা বানিয়ে দেবেন না। ও হ্যাঁ, শ্রীকান্ত আচার্য্য ও ভুল গান গেয়েছেন। ধ্রুবতারা নীল না, লাল।
মহাকাশ চর্চার অন্যতম একটা ভ্রান্ত ধারণা হলো পৃথিবীর কক্ষপথ নাকি এতো নিখুঁত ভাবে ভগবান/প্রকৃতি বানিয়েছে যে আর দশ- একশো কিলোমিটার এদিক ওদিক হলেই নাকি অনর্থ হয়ে যেত। হয় সমস্ত জীব জগত সূর্যের তাপে ভ্যানিশ হয়ে যেত, বা সূর্যের তাপ না পেয়ে বরফ হয়ে যেত। এই ব্যাপারে সবার আগে যে তথ্যটা দেব, সেটা হলো পৃথিবীর সূর্যের চারদিকে ঘোরার পথ বা কক্ষপথ কিন্তু বৃত্তাকার না, উপবৃত্তাকার। গোলাকার হলে সারা বছর সূর্য থেকে একটা নির্দিষ্ট দুরত্বেই পৃথিবী ঘুরে বেড়াতো, কিন্তু উপবৃত্তাকার হওয়ার জন্য বছরের বিভিন্ন সময় সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব আলাদা হয়। সব থেকে বেশি দূরে থাকলে এই দূরত্ব 15,20,97,597 কিলোমিটার আর সবথেকে কাছে থাকলে এই দূরত্ব 14,70,98,450 কিলোমিটার। অর্থাৎ সময়ে সময়ে প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ কিলোমিটার এদিক ওদিক করতে হয় পৃথিবীর কক্ষপথকে, আর তার জন্য জীবজগতের এত বৈচিত্র দেখতে পাই আমরা।
পৃথিবী থেকে সূর্যের গড় দূরত্ব হলো 14,95,97,870.7 কিলোমিটার আর এই দূরত্বকে বলা হয় এক (1) এস্ট্রোনোমিক্যাল ইউনিট। যে কোনো গ্রহে প্রাণ বিকশিত হওয়ার অন্যতম প্রধান শর্ত হলো, জলকে তরল অবস্থায় থাকতে হবে সেই গ্রহের পৃষ্ঠে সেই গ্রহের স্বাভাবিক বায়ুমণ্ডলের প্রেসারের বিরুদ্ধে। আর তার জন্য সেই গ্রহকে তার প্রধান তারা থেকে যে দূরত্বের মধ্যে থাকতে হয় সেটাকে বলে হ্যাবিটেবল জোন বা গোল্ডিলকস জোন। বিভিন্ন তারার ক্ষেত্রে এই দূরত্ব আলাদা আলাদা হয়। মূলত তারার তাপমাত্রার উপরে এটা নির্ভর করে। বর্তমান ধারণায় সূর্যের ক্ষেত্রে এই দূরত্ব শুরু হয় 0.38 এস্ট্রোনোমিক্যাল ইউনিট বা 5,68,47,190 কিলোমিটার থেকে। আর শেষ হয় 10 এস্ট্রোনোমিক্যাল ইউনিট বা 147,09,84,450 কিলোমিটারে। আর তার জন্যই মঙ্গল, চাঁদ এইসব জায়গায় প্রাণ থাকতে পারে এই ধারণা করা হয়। তবে, বিজ্ঞানের সংজ্ঞায়িত এই হ্যাবিটেবল জোনে থাকা পৃথিবীকে আমরা কতদিন হ্যাবিটেবল জোনে রাখতে পারবো সে উত্তর বিজ্ঞান দিচ্ছে না আপাতত।