দিনটা ছিলো বৃহস্পতিবার, গ্রেগরিয়ান কেলেণ্ডার তারিখ দেখাচ্ছে সতেরোই ফেব্রুয়ারী, ষোলশো খ্রিস্টাব্দ। সূর্য মাথার উপরে থাকলেও সেভাবে তেজ দেখাচ্ছে না। গোটা রোম শহরের প্রতিটা জীবিত প্রাণীর গন্তব্যস্থল যেন ‘ফুলের মাঠে’র দিকে। ‘ফুলের মাঠ’ নাম হলেও জায়গাটা পাথর দিয়ে বাঁধানো একটা চত্বর। সেই কোন মধ্য যুগে এখানে দারুন দারুন সব ফুল ফুটতো, তখনো রোম সারা পৃথিবীর খ্রিস্টান ধর্মের কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠেনি। ‘ক্যাম্পো দে ফিওরি’ বা ‘ফুলের মাঠ’ নামটা তখন থেকেই রয়ে গেছে।
আজ অবশ্য এত লোক জড়ো হচ্ছে, এক পাপীর মৃত্যুদন্ড কার্যকরী হতে দেখতে। দীর্ঘ সাত বছর ধরে বিচার চলেছে রোমান কার্ডিনাল বেলারমাইনের দপ্তরে, আগের মাসে মৃত্যুদন্ড দিয়েছে পোপ ক্লেমেন্ট। কার্ডিনাল বেলারমাইন পরে সেন্ট উপাধি পেয়েছিলেন, কিন্তু সে অন্য গল্প। মূলত আটটি অন্যায় করেছে বাহান্ন বছর বয়সী লোকটা, ক্রিস্টান ধর্মের মূল বিশ্বাসগুলোকে নিজের লেখালেখির মাধ্যমে ভ্রান্ত প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে, ভগবানের লিখিত নির্দেশদের বিপক্ষে নিজের স্বাধীন চিন্তাভাবনা জানিয়েছে। ভগবানের বিরুদ্ধে এ এক নিদারুন ষড়যন্ত্র।
বিচার সমাপ্ত করার আগে বেলারমাইন লোকটাকে শেষ সুযোগ দিয়েছিল, নিজের সমস্ত ধারণা থেকে সরে এসে ভগবান যীশুর দেখানো রাস্তাকেই একমাত্র রাস্তা বলে মেনে নিতে হবে, তাহলেই সব অন্যায় থেকে মুক্তি দেওয়া হবে তাকে।
তিবার নদী তীরের ‘নোনা’র মিনারে বসে পত্রপাঠ প্রত্যাখান করলো মাঝবয়সী লোকটা। সে আগেই জানিয়েছিল গির্জার ধর্ম-শিক্ষার বিরুদ্ধে সে যা যা বলে এসেছিলো, সেগুলো নিয়ে আর এগোবে না, কিন্তু তার নিজের বিশ্বাস, তার নিজের মহাবিশ্বকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গী সেটা সে ছাড়বে না।
গির্জার যুক্তিও ফেলে দেওয়ার না। দুটো সম্পূর্ণ বিপরীত ধারণা, গির্জার ধর্ম-শিক্ষা আর মাঝবয়সী লোকটার মহাবিশ্ব সম্বন্ধে ধারণা তো রাস্তায় মুখোমুখি হবেই। আর তা হলে দীর্ঘ ষোলশো বছর ধরে তৈরি হওয়া ধ্যান ধারণা তো মুখ থুবড়ে পরবে সবার সামনেই, গির্জার আধিপত্য নিয়ে প্রশ্ন উঠবে, আর তার ফলে সমাজে যে বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে তার দায়িত্ব খামোখা কেন নেবে গির্জা?
সাত বছর অনেকটাই সময়, পোপ অষ্টম ক্লেমেন্ট আর সময় দিতে রাজি নন কোনো পক্ষকেই। উনিশে জানুয়ারি কার্ডিনাল বেলারমাইনকে জানিয়ে দেওয়া হলো সে কথা। আর কিছু করার ছিলো না, পরের দিনই নিজের তদন্তফল গির্জাকে জানিয়ে দিলো বেলারমাইন।
ক্যাথলিকদের ধর্ম-বিশ্বাস, ক্রিস্টান ধর্মের ট্রিনিটি, ভগবান যীশুর দেবত্ব, কুমারী মেরি এবং যীশুর নিজের শরীরকে পাউরুটি এবং মদে পরিণত করা এই পাঁচটি বিশ্বাসের উপর সন্দেহ প্রকাশ করা ও এদের বিরুদ্ধ মত প্রকাশ করার মতন গুরুতর অপরাধ সন্দেহতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে বেলারমাইনের কোর্টে। লোকটা মনে করে বাইবেলের এইসব ঘটনা আসলেই সত্যি না, সাধারণভাবে যে কেউ চিন্তাভাবনা করলেই বুঝতে পারবে যীশুর নিজের শরীরকে ওয়াইন আর পাউরুটি বানানো গল্পগাঁথা ছাড়া আর কিছু না।
স্প্যানিস ইনকুইজিশনের সময়ে চার্চ দ্বারা অনুমোদিত ক্রিস্টান ধর্মের যেকোনো ইতিহাসের বিরুদ্ধে মতপ্রকাশের সঠিক বিচার মৃত্যুদন্ড ছাড়া আর কিছু হতে পারে না।
অনেক ভেবে ক্রূশে চড়ানোর নির্দেশকে যথার্থ মনে করলেন পোপ ক্লেমেন্ট। এই নবজাগরণের সময়ে বেশ কিছু লোকের ধর্ম-বিশ্বাসের বিরুদ্ধে বলা এখন গা-সওয়া হয়ে গেছে ক্লেমেন্টর, আর তার জন্য তাদের মৃত্যুদন্ড দিতে এক ফোঁটাও হাত কাঁপে না ওর। সেটাই লিখলো, কিন্তু আরো অন্যরকম শাস্তি দেওয়া যায় কিনা সেটা দেখতে গিয়ে পুরো কাগজগুলো ওল্টালো ক্লেমেন্ট। বেলারমাইন ছাড়াও অন্য কয়েকজন কার্ডিনাল এই লোকটাকে আরো তিনটে অন্যায়ের সাথে অভিযুক্ত করেছে যা কিনা পাতা শেষ হয়ে যাওয়ার জন্য পরের পাতায় অতিরিক্ত চার্জ হিসাবে লিখেছে বেলারমাইন।
শেষ তিনটে অপরাধের বিবরণ পড়তে পড়তে মাথায় রক্ত চড়ে গেল ক্লেমেন্টর। লোকটার সাহস দেখে এই মুহূর্তে হাতির পায়ের তলায় পিষে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করলো ক্রিস্টান ধর্মের সর্বোচ্চ ক্ষমতাবান পোপ ক্লেমেন্টের!
শয়তানটা পঞ্চাশ বছর আগে মরে যাওয়া একজন প্রুশিয়ানের কাজকে সত্যি ধরে ছাইপাশ লিখেছে নিজের একটা বইতে, ঘটা করে নাম দিয়েছে ‘অসীম মহাবিশ্ব ও পৃথিবী’। প্রুশিয়ানটাও মরার আগের দিন একটা বই লিখেছিল ‘মহাকাশীয় গোলকের ঘূর্ণন’, সব কিছু নাকি সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। ভালোই হয়েছিল, বই লিখেই মরে গেছে, নইলে ওটাকেও শুলে চড়াতে হতো।
কিন্তু এই ছাগলটা সেটা থেকেও এক কাঠি উপরে উঠে লিখছে, ভগবানের নিজের হাতে সৃষ্টি করা এই পৃথিবী, যেখানে ভগবান মানুষের মতন সর্বশ্রেষ্ট প্রাণী সৃষ্টি করে গেছেন, আদম আর ইভকে নিজের হাতে বহিষ্কার করেছেন, সেটা নাকি একমাত্র পৃথিবী না!
লোকটা নাকি প্রমাণ করে দেখাতে পারে মহাকাশে যত বিন্দু আছে সব নাকি এক একটা সূর্য, আর তাদেরও নাকি একাধিক পৃথিবী আছে? সেখানেও হয়তো মানুষও আছে! ভগবান নাকি এই একটা মাত্র পৃথিবী সৃষ্টি করেনি।
ইয়ার্কি হচ্ছে চার্চের সাথে?
আবার লোকটা নাকি ম্যাজিকেও বিশ্বাস করে, এও বিশ্বাস করে মানুষের আত্মা নাকি পরজন্মে অন্য প্রাণীর শরীরেও যেতে পারে। উফফ!! আর নিতে পারলো না পোপ ক্লেমেন্ট, সিদ্ধান্ত নিলো এমন একটা শাস্তি দিতে হবে, যেটা আগামী এক হাজার বছরেও পৃথিবীর ইতিহাস থেকে মোছার সাহস কেউ করবে না, স্বাধীনভাবে চিন্তার নামে এইসব বিদ্রোহ মেনে নেওয়া যায় না।
ক্রূশে চড়ানোর নির্দেশকে কেটে দিয়ে নতুন নির্দেশ লিখলো ক্লেমেন্ট, পা উপরে মাথা নিচু করে বেঁধে রেখে আগুনে পুড়িয়ে দিতে হবে লোকটাকে। আর সেটা জেলের বন্ধ দেওয়ালের মধ্যে না, জনসমক্ষে। কোথায় করা যেতে পারে, সেটা ভাবতে গিয়ে মাথায় একটা আইডিয়া এলো ক্লেমেন্টের। ‘ফুলের মাঠে’ই পোড়ানো হোক শয়তানটাকে, তারপর যদি ক্ষমতা থাকে তাহলে ফুল হয়েই ফুটে উঠে বিশ্বকে জানিয়ে দিক ক্রিস্টান ধর্ম মিথ্যে, ওর চিন্তা ভাবনাই ঠিক।
আদেশ শেষ করে চিঠি নির্দেশ আকারে ক্লেমেন্ট পাঠিয়ে দিলো কার্ডিনাল বেলারমাইনকে।
নির্দেশ ভালো করে পড়ে বেলারমাইন ডেকে পাঠালেন শহরের ঘোষককে, শহরবাসীকে জানিয়ে দেওয়া হলো ‘জিওরদানো ব্রুনো’ নামের পাষণ্ডর বিচার শেষ হয়েছে। মহামান্য পোপ ক্লেমেন্ট তার ন্যায় বিচারের স্বর্গীয় অনুমোদন পেয়ে গেছেন। অতঃপর পাঁচ দিন পরে বিচারসভায় সেই রায় শোনানো হবে। সবাইকে উপস্থিত থাকতে অনুরোধ করা হচ্ছে।
দিন পাঁচেক পরে কোর্টরুমে এসে পৌঁছালো ব্রুনো, মিনারের ঘর থেকে তাকে বেঁধে আনা হয়েছে। কালো গাউন পরে আছে লোকটা, সেই গাউনের একটা অংশ মাথাকে ঢেকে রেখেছে।
তোমায় উল্টো করে ঝুলিয়ে আগুনে পোড়ানো হবে! জানিয়ে দিলো কার্ডিনাল বেলারমাইন, পোপের নির্দেশ কার্যকর হবে সামনের সতেরোই ফেব্রুয়ারী। আরো জানালো হলো, মৃত্যুর আগে জিভ কেটে নেওয়া হবে, সেই জিভকে বন্দী করা হবে, যুগ যুগ ধরে লোকে এসে সেই পাপী জিভকে দেখবে যে যীশুর বিরুদ্ধে নোংরা কথা বলার সাহস দেখিয়েছিল।
হেসে উঠলো ব্রুনো, সবার সামনে। তারপর কার্ডিনাল বেলারমাইনের দিকে উদ্দেশ্য করে বললো, “আমি ত শুধু বলেছিলাম মহাবিশ্ব একটাই, আর অসীম ও অন্তহীন। তাই মহাবিশ্বকে যা আপনাদের বইতে লেখা আছে সেই ছোট গণ্ডিতে বেঁধে রাখতে পারবেন না। রাতের আকাশের প্রতিটা বিন্দুই এক একটা সূর্য, যার নিজের আলো আছে, তাপ আছে। আর তাই তাদের পৃথিবী থাকাও অবিশ্বাস্য না। এইটুকু ভাবা কি অপরাধ? এই ভাবনার শাস্তি এই?”
“আপনি যে শুধু বাইবেলে লিখিত বর্ণনার বিরুদ্ধে ভেবেছেন তাই নয়, সেটাকে নস্যাত করার উদ্দেশ্যে এইসব গাল-গল্প লিখেছেন”, কার্ডিনাল বেলারমাইন বললো, “যখন লিখেইছেন তখন ভেবে লেখা উচিত ছিলো, এখন আদেশ চলে এসেছে। তা যথাযথ ভাবে পালিত হবে।”
উঠে পড়লো কার্ডিনাল বেলারমাইন, আর এক মুহূর্ত থাকতে ইচ্ছে করছে না এই লোকটার সামনে। কি গভীর চোখ লোকটার, দৃষ্টি যেন অন্তর্ভেদী, বিবেকের মর্মস্থলে বিদ্ধ করছে বেলারমাইনকে। এই মৃত্যুদন্ড দিয়ে যেন নিজেই ভীত হয়ে পড়েছে বেলারমাইন।
“ভয় পাচ্ছেন কার্ডিনাল?” ব্রুনো চেঁচিয়ে উঠলো। তারপর অট্টহাসি হেসে বললো, “আপনার মুখ বলছে আপনি ভয় পেয়েছেন! কিসের ভয় আপনার? আমি তো মরে যাবো, কিন্তু আপনি আমার থেকেও বেশি ভয় নিয়ে বাঁচবেন। জানেন কেন? কারণ আপনি জানেন আমি ভুল লিখিনি।”
কেঁপে উঠলো কোর্টরুম। কার্ডিনাল বেলারমাইন সভা ত্যাগ করলো চোরের মতন পালিয়ে। ব্রুনোর হাসি থামলো না।
‘ক্যাম্পো দে ফিওরি’তে দুপুর বারোটাতে একটা কাঠের শুলে বেঁধে আনা হলো জিওরদানো ব্রুনোরকে। আগের দিন রাতেই জিভ কেটে নেওয়া হয়েছে, সেটা এখন একটা লোহার খাঁচায় একটা টেবিলের উপর রাখা আছে। কার্ডিনাল বেলারমাইন নিজে এসেছে কাজটা শেষ করতে। শেষ কয়েকদিন ধরে ইউরোপে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ব্রুনোর সব বই যোগাড় করে পুড়িয়ে ফেলতে হয়েছে ওকে। বইগুলোকে ‘নিষিদ্ধ বইয়ের তালিকায়’ উঠিয়ে সব চার্চকে নির্দেশ দিয়ে দিয়েছে যে, এই বই যে পড়বে তাকে রাষ্ট্রদ্রোহী ঘোষণা করা হবে।
সবার সামনে পোপের নির্দেশ আবার পড়ে শোনালো রোম শহরের ঘোষক। তারপর সবার সামনে কাঠের ক্রূশে আটকানো ব্রুনোকে উল্টো করে দেওয়া হলো। মাথাকে রাখা হলো পাতালের দিকে, যাতে করে মরলে স্বর্গে না যেতে পারে কোনোমতেই। সব শেষ হলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হলো। রোমের মানুষ বাকরুদ্ধ হয়ে দেখলো জীবন্ত অবস্থায় পুড়ে যাচ্ছে জিওরদানো ব্রুনো, স্বাধীন চিন্তার পথপ্রদর্শক, বিজ্ঞানের প্রথম শহীদ।
ব্রুনো যখন পুড়ছিলো তখন বেলারমাইনের চোখ আটকে ছিলো কাটা জিভটার উপর। ভয় পেয়েছিল কার্ডিনাল, ব্রুনোকে পোড়ালেও তার চিন্তাভাবনাকে আটকাতে পারবে না সেটা বুঝতে পেরেছিল। তাই ব্রুনোর ছাই তিবার নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে জিভটাকেও নষ্ট করে ফেলেছিলেন কার্ডিনাল বেলারমাইন, পরবর্তীকালের সেন্ট এবং ডক্টর অফ দ্যা চার্চ।