প্রশ্ন: খামারে কি হয়?
উত্তর: চাষ হয়।
পৃথিবীর যেকোনো প্লেয়ার প্রথমে ফুটবল শেখা শুরু করে কোনো ফুটবল একাডেমীতে। সেটা কোনো বড় ক্লাবের একাডেমী হতে পারে, আবার ছোট ছোট ব্যক্তিগত প্রয়াসে গড়ে ওঠা একাডেমীও হতে পারে। মূলত এক বা দুজন কোচের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে এই সব ছোট ছোট একাডেমীগুলো।
পৃথিবীর সব একাডেমীর প্রধান কাজই হলো পেশাদার খেলোয়াড় তৈরি করা। এই একাডেমীগুলোকে ফুটবলের মেন সাপ্লাই লাইন বলা যেতে পারে। বড় বড় ক্লাব জুনিয়র ট্যালেন্টেড প্লেয়ার কেনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য একাডেমীর উপরই ভরসা করে থাকে।
যেকোনো ফুটবল ক্লাবের বছরের বছর টিকে থাকতে গেলে সব থেকে বেশি দরকার হয় নির্ভরযোগ্য প্লেয়ার তৈরির একাডেমী। একাডেমী না থাকলে ওপেন মার্কেট থেকে প্লেয়ার কিনতে পকেট অনেকটাই খালি করতে হয়।
আয়াক্স আমস্টারডামের মতন ক্লাব আবার একাডেমী থেকে প্লেয়ার বিক্রি করেই মূলত প্রথম দলকে ফান্ড করে। একুশ শতকে বার্সার আইকনিক দলের সোনা বাঁধানো মাঝমাঠ ও কিন্তু লা মাসিয়া একাডেমির অবদান।
মোহনবাগান সেইল একাডেমী অতীতে সারা ভারতে প্লেয়ার সাপ্লাইয়ের অন্যতম ভরসা থাকলেও ময়দানি ডামাডোলে আজ অনেকটাই সঙ্কটে। একাধিক সেরা একাডেমী না থাকার প্রত্যক্ষ প্রভাব আজ ভারতীয় জাতীয় দলকে ভালোভাবেই সঙ্কটে ফেলেছে।
কিন্তু এই একাডেমী চিন্তাভাবনা কি আস্তে আস্তে ফুটবল দুনিয়া থেকে লুপ্ত হতে চলেছে?
সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের অন্যতম সেরা একটা ক্লাবের ম্যানেজমেন্ট সেই দিকেই নিয়ে যেতে চলেছে ফুটবল বিশ্বকে।
ম্যানচেস্টার সিটির হোল্ডিং কোম্পানী শেখ মনসুরের সিটি ফুটবল গ্রুপ এই মুহূর্তে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের পাঁচটা ক্লাবের একশো শতাংশের মালিক, পঞ্চাশ শতাংশের বেশি শেয়ার রয়েছে তিনটে ক্লাবে। আর আরো তিনটে ক্লাবে বেশ ভালরকম ভাবেই ইনভেস্টমেন্ট করে রেখেছে সিটি গ্রুপ।
এদের মধ্যে ম্যানচেস্টার, নিউ ইয়র্ক, মেলবোর্ন, মন্তেভিডিও, মুম্বাইয়ের দলগুলো নিজেদের নামের শেষে সিটি নাম লাগিয়েই খেলছে। বাকি দল গুলোও খুব তাড়াতাড়িই এইভাবে নাম পরিবর্তন করবে বলেই মনে হয়।
ক্রীড়া জগতে এই ধরনের মাল্টি ক্লাব মডেলকে খামার হিসেবেই গণ্য করা হয়। মূলত রাগবি খেলায় এই মডেলের ব্যবহার থাকলে ও ফুটবলের দুনিয়া একদমই নতুন কনসেপ্ট এই খামার।
সিটি ফুটবল গ্রুপের আগে রেড বুল ফুটবল গ্রুপ এই মডেলের প্রচলন করে ফুটবল দুনিয়াতে। বর্তমানে সালসবার্গ, লিপজিগ, নিউ ইয়র্ক, রেড বুল ব্রাসিল আর এফ সি লিয়েফারিং ক্লাবের মালিক রেড বুল কোম্পানী। যদিও ফুটবল ছাড়াও আরো অনেক ধরনের খেলা যেমন ফর্মুলা ওয়ান, মোটো জিপি, আইস হকি, সেইলিং ও সার্ফিংয়ের সাথে সরাসরি যুক্ত রেড বুল কোম্পানী।
সিটি মডেলের থেকে রেড বুল মডেল আলাদা বেশ কিছু জায়গাতে। সিটি গ্রপের ফুটবল ছাড়া আর কোনো খেলতে ইনভেস্টমেন্ট না থাকার জন্য অনেক বেশি রিসোর্স এই একটা খেলাতে ওরা দিতে পারে। সিটি ফুটবল গ্রুপের দলগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যায়।
এগারোটা ক্লাবের মধ্যে দুহাজার একুশ বাইশ মরশুমে তিনটে ক্লাব তাদের নিজের দেশের সর্বোচ্চ লীগ জিতেছে। বাকি দলগুলোও যথেষ্ট ভালো রেজাল্ট করে নিজেদের সুনাম বজায় রেখেছে।
উল্টো দিকে রেড বুলের দলগুলো ভালো রেজাল্ট করলেও ধারাবাহিক ভাবে ট্রফি জেতা এখনো শুরু করেনি।
সিটি গ্রুপের এই খামার ব্যবস্থা দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক বিনিয়োগের পক্ষে যথেষ্ট ইতিবাচক পদক্ষেপ বলেই মনে করা হচ্ছে। ইনভেস্টরদের মাইলেজ পাওয়ার জন্য সিটি গ্রুপের ট্রফির সাফল্য দারুণ একটা আকর্ষনীয় বিষয়। বিভিন্ন মহাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জন্য কোনো না কোনো ক্লাব কিছু না কিছু জিতবেই এটা ধরেই প্রচুর বিনিয়োগকারী সিটি গ্রুপের সাথে যুক্ত হয়ে চলেছে নিয়মিত। যেখানে কোনো একটা ফুটবল ক্লাব বছরে খুব বেশি হলে ছ' টা ট্রফি জিততে পারে, সেখানে সিটি গ্রুপের ট্রফি জেতার সম্ভাবনা পঞ্চাশের উপর। গোটা পৃথিবী জুড়ে এরকম রাজত্ব এর আগে কেউ ভাবতে ও পারেনি।
এতো গেল ভালো দিক, কিন্তু এর বিপরীত প্রান্তে যে সমস্যা এই ব্যবস্থা তৈরি করছে তা গোটা ফুটবল ব্যবস্থাকেই লাটে তুলে দিতে পারে।
এগারোটা সেরা ক্লাবের মালিক মানে কিছু না হলেও প্রায় তিনশোর উপর প্লেয়ার সিটি ফুটবল গ্রুপের সাথে চুক্তিবদ্ধ। যেকোনো দল এদেরকে কিনতে চাইলে সরাসরি সিটি গ্রুপের সাথে দর কষাকষিতে নামতে হবে, যা অনেক দলের পক্ষেই কষ্টসাধ্য। এতে করে প্লেয়াররা চাইলেও চুক্তি শেষ হওয়ার আগে সিটি গ্রুপ ত্যাগ করা ওদের পক্ষেও খুব একটা সহজ হবে না। অনেকক্ষেত্রেই একবার সিটি গ্রুপের সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পর বের হওয়ার রাস্তা হিসাবে শুধু রিটায়ারমেন্টই খোলা থাকবে।
বেশ কিছু রিপোর্ট অনুযায়ী, নিজেদের এগারোটা ক্লাবের মধ্যে যখন খুশি প্লেয়ার পরিবর্তন করতে পারে সিটি গ্রুপ। সেক্ষেত্রে কোনো একটা দেশের লীগ বা কোনো একটা ট্রফিকে টার্গেট করে দল গঠন করে ফেলতে পারবে সিটি গ্রুপ। সেই দেশের ফুটবলের জন্য সেটা খুব একটা ভালো বিজ্ঞাপন যে হবে না সেটা বলাই বাহুল্য।
সব থেকে বেশি সমস্যা তৈরি করতে পারে ফাইন্যান্সিয়াল ফেয়ার প্লের ক্ষেত্রে। সাধারণত কোনো ফুটবল ক্লাবের আয় ও ব্যায়ের সামঞ্জস্য বজায় রাখতে এই নিয়ম প্রচণ্ড জরুরি। এবার এগারোটা দেশে এগারোটা ফুটবল ক্লাব নিয়ন্ত্রণ করা সিটি গ্রুপ বলতেই পারে, তারা ভারতের লীগে খেলে লাভের অঙ্ক ব্রাজিলের লীগে খেলা দলে ব্যয় করছে বা সব দেশ থেকে যা লাভ করছে সব ম্যানচেস্টার সিটিকে উন্নত করার জন্য ব্যয় করছে। সেক্ষেত্রে ফিফা বা অন্য কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থার কিছু করার থাকবে না, যা উয়েফা কিছু বছর আগে ম্যানচেস্টার সিটির সাথে করেছিল, ফাইন্যান্সিয়াল ফেয়ার প্লে নিয়ে সতর্ক করে। সময় যত যাবে, এই ব্যাপারে ফুটবল বিশ্বে ততই সমস্যা হবে।
এছাড়াও এই এগারোটা দলকে যদি ফুটবল মাপকাঠি দিয়ে বিচার করা হয়, তাহলে ম্যানচেস্টার, নিউ ইয়র্ক, মেলবোর্ন ছাড়া বাকিগুলো সিটির প্লেয়ার তুলে আনার ক্ষেত্র হিসাবেই ব্যবহার হবে।
অন্যান্য ক্লাব এই মডেলের সামনে মুখ থুবড়ে পড়বে আশা করাই যায়। একে তো আরব দেশের তেল বিক্রির অফুরন্ত সম্পদের সামনে ইউরোপ আমেরিকার পুঁজিপাতি ফুটবল মালিক সমাজের দিশেহারা অবস্থা, তার উপর তাদের যদি এগারোটা দলের সম্মিলিত সাফল্যের সাথে লড়তে হয়, তাহলে আমার মনে হয় না তারা খুব বেশিদিন এই লড়াই লড়তে আগ্রহী থাকবে। এই প্রতিবেদন লেখার সময়, লিভারপুলের আমেরিকান মালিক লিভারপুল ক্লাবকে চালানোর অপেক্ষা বেঁচে দেওয়াই শ্রেয় মনে করেছে। যদিও বর্তমান লিভারপুল মালিক জন হেনরি কিন্তু ফুটবল ছাড়াও বাকি খেলায় তার যে বিনিয়োগ আছে তা থেকে সরে আসছে না। বিভিন্ন রিপোর্ট অনুযায়ী সিটি গ্রুপের মালিক শেখ মনসুরের কাকা লিভারপুল কিনতে আগ্রহ দেখিয়ে থাকলেও শেষ পর্যন্ত ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের দিকে যেতে পারেন।
2022 -23 মরশুমে নিউক্যাসেলের সাফল্যের প্রধান কারণও কিন্তু বর্তমান মালিক সৌদি আরবের পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ডের অফুরন্ত টাকার যোগান। গ্লেজার পরিবার ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ত্যাগ করলে সেখানেও আরব শেখদের পদধ্বনি শোনা যাবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
এতে করে মার খাবে ইউরোপের দ্বিতীয় সারির দলগুলো। আরব ডলারের পদধ্বনি কিন্তু ওই অবধি পৌঁছাচ্ছে না। পিএসজি তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। ওই দল টা ছাড়া কোনো আরব শেখ ফ্রান্সের লীগে বিনিয়োগ করতে আগ্রহ দেখায়নি।
সিটি গ্রুপের এই খামার সিস্টেম আখেরে ক্ষতি করবে ক্লাব গুলোর এতদিন ধরে চলে আসা লেগাসিকে। ময়দানের ট্রান্সফার রোমাঞ্চর লেগাসিকে শেষ করে দিয়েছিল ইউ বি গ্রুপের ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগানকে একসাথে স্পনসর করার সিদ্ধান্ত। অনেকগুলো ক্লাবে একসাথে ইনভেস্টমেন্ট করা খেলাধুলার জগতে এমন কিছু নতুন না হলেও ফুটবলের ইতিহাসে এটা সম্পূর্ন নতুন চিন্তাভাবনা। এতদিন অবধি খুব বেশি হলে ইউরোপের প্রথম ডিভিশনের ক্লাব গুলো বাকি বিশ্বে বেশ কিছু ছোট ক্লাবের সাথে টাই আপ করে রাখতো ফুটবল প্রসারের জন্য।
কিন্তু সিটি গ্রুপের এই খামার ব্যবস্থা একদমই নতুন একটা যুদ্ধ ক্ষেত্র হতে চলেছে অদূর ভবিষ্যতে। যদি বিশ্বের সব লীগেই একটা করে ক্লাব কিনে রাখতে চায় তাহলে এই মুহূর্তে সিটি গ্রুপকে আটকানোর মতন কোনো নিয়ম নেই ফুটবল বিশ্বে। যদি তাই হয় তাহলে খুব তাড়াতাড়ি চ্যাম্পিয়ন্স লীগের সেমি ফাইনালে মুখোমুখি হতেই পারে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার সিটি, ফ্রান্সের কোনো এক সিটি, ইতালির আরেক সিটি আর স্পেনের অন্য কোনো সিটি। তাতে করে ফুটবলকে সমর্থন করতে আর ইচ্ছে করবে কি?