"ওই যে কসমস বলে বইটার লেখকের কথা বলছো?"
"হ্যাঁ, কসমসের লেখক কার্ল সাগান। যদিও উনাকে শুধু কসমস বইয়ের লেখক বলে চেনা আর রবি ঠাকুরকে শেষের কবিতার জন্য চেনা ব্যাপারটা একই!"
"বুঝলাম না।"
"শেষের কবিতা যেমন রবি ঠাকুরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজ, কিন্তু তা বলে সেটাই উনার একমাত্র কাজ না। উনি এতকিছুতে উনার নান্দনিকতার ছাপ রেখে গেছেন, তবুও যদি কোনো একটা বিষয়ে কথা বলতে হয় তাহলেও দেখবি সেই বিষয়ে উনার সেরা কাজ কোনটা সেটা বার করা বাঙালির পক্ষে প্রায় অসম্ভব একটা কাজ হয়ে যায়।"
'আচ্ছা, তো তুমি বলছো কার্ল সাগানের ওই ব্যাপারে আরো কাজ আছে, কসমস বইটা একমাত্র না।"
"আসলে কি জানিস তো উনি, উনার জীবনে মাত্র দুটো কাজ করেছিলেন, আর সেই দুটো কাজ বিজ্ঞানের ইতিহাসে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, কাজটার প্রভাব কতটা সেটার মূল্যায়নও হয়তো সম্ভব না।"
"আইনস্টাইনের রিলেটিভিটির মতন?"
"না রে, ওরকম না। উনি ওরকম কোনো থিওরি দেননি পৃথিবীকে বরং বলতে পারিস ওর ঠিক একশো আশি ডিগ্রি উল্টো একটা জিনিস দিয়েছিলেন। অনেকটা নচিকেতার বোকা বুড়োর মতন, গান টা শুনেছিলিস?"
"হ্যাঁ, we shall overcome তো, সেই বুড়ো লোকটা গাইতি চালিয়ে একটা পাহাড় ভেঙে রাস্তা বানাবে, মাউন্টেন ম্যান মানঝির গল্প?"
"না, গল্পটা মনে হয় না মানঝির গল্প, মানঝিজি ও পাহাড় ভেঙে রাস্তা বানিয়েছিলেন, কিন্তু নচিকেতার গানে যেটা ছিল, সেটাতে হ্রদ ছিল। গল্পদুটোর সাদৃশ্য থাকলেও সেটা মনে হয় না এক গল্প। যাই হোক, বারবার উপমা চলে আসছে, এবার আসল গল্পে আসি। না দাঁড়া গল্পটা উল্টো দিকে দিয়ে শুরু করি। নাসার গোল্ডেন রেকর্ডস জানিস?"
"জানি। ভয়েজার-1 এ রাখা একটা রেকর্ড। তাতে করে পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীদের ডাক রেকর্ড করে রাখা আছে। ওটা ভয়েজার-1 এ করে সৌরজগৎ ছেড়ে বিশ্ব-ব্রম্মান্ড ঘুরে বেড়াবে।"
"ঠিক বলেছিস, জানিস তো এই রেকর্ডটা আসলে সমুদ্রে ভেসে থাকা একটা বোতলের মতন, আগেকার দিনে যখন কোনো নাবিক সমুদ্রের ঝড়ে আটকে পরে কোনো অচেনা দ্বীপে গিয়ে উঠতো, সে তখন সম্ভব হলে একটা বোতলের মধ্যে তার নাম ঠিকানা দিয়ে সমুদ্রে ভাসিয়ে দিত। সমুদ্রস্রোত, সেটা ভাবিকালে তুলে দিত ,অচেনা এডভেঞ্চারের আশায় পারে বসে থাকা কোনো বালকের হাতে। তারপর সে বেরিয়ে পড়তো হয়তো সেই নাবিককে খুঁজতে। হয়তো সেই নাবিক কয়েক শতাব্দী আগেই মরে ভূত হয়ে গেছে। সেই বোতলের মতনই এই গোল্ডেন রেকর্ড আমরা মরে ভূত হয়ে যাওয়ার পর হয়তো পৌঁছাবে কোনো গ্রহে, যেখানে হয়তো আমাদের মতন বুদ্ধিমান প্রাণীরা সেটা নিয়ে জানতে পারবে, তাদের মতো আমরাও ছিলাম। তারা হয়তো অচেনার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরবে। নাসার এই রেকর্ড কমিটির প্রধান ছিলেন কার্ল সাগান। এই রেকর্ড তার প্লানিংয়ের ফল। রাশিয়ান ইউরি গ্যাগারিন পৃথিবীতে মানব সভ্যতার প্রায় পঞ্চাশ হাজার বছরের শৃঙ্খল কাটানোর ডানাতে প্রথম হাওয়া দিয়েছিলেন, আমেরিকান নীল আর্মস্ট্রং এক ধাপ এগিয়ে ডানা মেলে উড়ে অন্য এক জায়গায় পা দিয়েছিলেন, সেখানে মানুষ হিসাবে কার্ল সাগান আমাদের মননকে রওনা করে দিলেন সৌরজগৎ ছেড়ে। গোল্ডেন রেকর্ডে যারা আছেন তারা কিন্তু কিন্তু কেউ কোনো দেশের না, কোনো জাতির না, কোনো প্রজাতির না। গোল্ডেন রেকর্ড পৃথিবীর। সম্ভবত এই বিশ্বব্রম্মান্ডের অসীম শুন্যতায় ঘুরে বেড়ানো একটা পাথরের মধ্যে জীবিত থাকা একদল জীবের গল্প। এই পৃথিবীতে প্রথম দিন থেকেই বুদ্ধিমান প্রাণীরা শুধু লড়ে গেছে, সে ডাইনোসরের সাথে সেই সময়ের উভচরদের হোক বা হালফিলের মানুষদের মধ্যে রাসায়নিক যুদ্ধ। গোল্ডেন রেকর্ড কিন্তু সহাবস্থানের গল্প। বলতে পারিস বিশ্বশান্তির গল্প। আগে এই সহাবস্থান কোনোদিন ও হয়নি। কিন্তু ভবিষ্যতে হতেই পারে। কার্ল সাগান এই স্বপ্নের কান্ডারি। গোল্ডেন রেকর্ড তাই তার ম্যাগনাম ওপাস। উনি বর্তমান পৃথিবীর নোয়া। বাইবেলের নোয়ার গল্পে যেমন মহাপ্লাবনের সময় নোয়া সমগ্র প্রাণীকুলকে একটা নৌকায় তুলে নিয়ে প্রাণীজগত রক্ষা করেছিলেন, কার্ল সাগান ও তেমনি আমাদের মননকে ভবিষ্যতের জন্য রক্ষা করে পাঠিয়ে দিয়েছেন মহাবিশ্বের কোলে, যেখানে আমরা না মানুষ, না জন্তু, না জানোয়ার, না পাখি না সাপ, আমরা সূর্য নামের এক গ্রহের চারিদিকে ভেসে বেড়ানো তিন নম্বর পাথরে টিকে থাকা একদল বুদ্ধিমান, যারা অন্যদের সাথে কথা বলতে চায়, ব্যাস।"
"এত দুর্দান্ত জিনিস! কিভাবে করলেন উনি এইসব? আর এটা যদি একটা কাজ হয়ে থাকে তাহলে দ্বিতীয়টা কি? আর নচিকেতার গানটার কি হলো?"
"এবার ওটাই বলবো। গোল্ডেন রেকর্ডে কার্ল সাগান ভেঙে দিয়েছিলেন মানুষের ইগোকে। ওর আগে উনি যেটা বানিয়েছিলেন সেটা হলো পাইওনিয়ার প্লেক, নাসার পাইওনিয়ার স্পেসক্রাফটের উপর লাগানো আছে। ওটার উপরে নারী-পুরুষের অবয়ব ও সৌরজগতে আমাদের অবস্থান আর কিভাবে পাইওনিয়ার সৌরজগতের পঞ্চম গ্রহকে পাশ কাটিয়ে বেরোলো তার একটা ছবি বানানো আছে। উনি উনার এই দ্বিতীয় চিঠিটা মহাবিশ্বের কাছে পাঠিয়ে আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, সৌরজগতের এই তৃতীয় গ্রহে বেঁচে থাকা মানুষের আওয়াজ আর সমুদ্রের ঢেউয়ের আওয়াজের গুরুত্ব এক। হয়তো কাজ আলাদা। কিন্তু তার আগে তিনি ভেঙে দিয়েছিলেন আরো একটা প্রাচীর। হয়তো সবথেকে কঠিন প্রাচীর ছিল ওটা। কিন্তু ওর গল্পো আর একটু পরে। বিকেলে বলবো।"
"না না এখনই বলো। এরকম জীবনী শুনিনি।"
"কার্ল সাগান এক অনন্ত জীবন রে। একদিনে হয় না হতে পারে না।"
"আচ্ছা এবার বলবে তো, কার্ল সাগানের দ্বিতীয় মহান কাজটার ব্যাপারে?"
"দ্বিতীয়টাই তো আগে বললাম, বল প্রথমটা। আসলে কিছু কিছু কাজ থাকে যেটার কোনো কাগজে সার্টিফিকেট থাকে না, কিন্তু তার প্রভাব এতটাই হয় যে পরবর্তী প্রজন্মকে সম্পূর্ণ বদলে দেয়। ড্যান ব্রাউনের অরিজিন বইটা পড়েছিস?"
"পড়েছি, মানুষের প্রধান দুই অজানা প্রশ্ন নিয়ে বলছো তো?"
"ঠিক, এই দুটো প্রশ্নের উত্তরই মানুষকে মানুষ বানিয়েছে, এই গ্রহের পঞ্চাশ হাজার বছরের গোলামী কাটাতে বাধ্য করেছে। আর এই দুটো প্রশ্নই প্রধান প্রধান ধর্মের মূলনীতি তৈরি করেছে। আমরা কোথা থেকে এলাম? আর আমরা কোথায় যাচ্ছি?
ধর্মগুলো নিজেদের মতন করে এর উত্তর খুঁজেছে আর সেটাকেই প্রমান করার জন্য থিওরি বানিয়ে গেছে। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এব্যাপারে একটা মুশকিল ছিল।
প্রথম প্রশ্নটাই ভাব, 1930 এ এডউইন হাবল মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে এটা প্রমানসহ না দেখালে বিগ-ব্যাঙ এর ধারণাটা আসতো কিনা সন্দেহ, অর্থাৎ আমরা যে এক সময় একটা বিন্দুর থেকেও ছোট ছিলাম এবং সেখান থেকেই হটাৎ করে মহাবিশ্বের সৃষ্টি এটা মানতে আর এটাকে প্রমান করতে খাটতে হতো অনেক। দ্বিতীয় প্রশ্নটাও দেখ, এই হাবলের পর্যবেক্ষণ ছাড়া সেটার গুরুত্ব সেই সময় বিজ্ঞানের কাছে একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার ছিল, তাই নয় কি?"
"হ্যাঁ, সে তো হবেই, সংকোচনটা মানাই তো কঠিন, কিছুই ছিল না সেখান থেকে হটাৎ করে এত কিছু?"
"এইখানেই গল্পে ঢুকবেন প্রফেসর হ্যারল্ড উরে। নোবেল পেয়েছিলেন রসায়নে। কিন্তু যে জন্য উনি এইগল্পে প্রাসঙ্গিক, সেটার জন্য নোবেল পাননি।"
"অনেকটা আইনস্টাইনের মতন।"
প্রফেসর হ্যারল্ড উরে
"হ্যাঁ, প্রফেসর উরে আর তার ছাত্র মিলার মিলে 1952 সালে একটা পরীক্ষা করলেন, ইতিহাসে তা উরে-মিলার পরীক্ষা নামে নন্দিত। সেই সময়ের হিসেব অনুযায়ী, পৃথিবীতে প্রথম প্রাণ সৃষ্টির সময়ে পৃথিবীর রাসায়নিক অবস্থাকে ল্যাবে তৈরি করলেন। বলতে পারিস প্রথম প্রাণ সৃষ্টির ঠিক আগের মুহূর্তে চলে গেলেন। তখনো পৃথিবী ঠান্ডা হয়নি। মাটি তৈরি হয়নি, জল তরল রূপে নেই, চারদিকে মুহুর্মুহু বাজ পড়ছে। এরকম একটা ছোট্ট পৃথিবী বানালেন তারা। বাজের জায়গার ব্যবহার করলেন সেই অনুপাতের ইলেকট্রিক কারেন্ট। দেখতে চাইলেন আদেও কি হটাৎ করে এই রাসায়নিকরাই নিজে থেকে এমিনো এসিড তৈরি করতে পারবে? যা আদতে প্রান তৈরির ভিত, বিল্ডিং ব্লক অফ লাইফ। যদি সেদিন প্রমান করতে পারতেন তাহলে প্রথম প্রশ্নের উত্তর নিয়ে আর ভাবতে হতো না। প্রমান হয়ে যেত পৃথিবীতে প্রাণ আসলে একটা দুর্ঘটনা। অবশ্যই ভালো দুর্ঘটনা, হয়তো কয়েক কোটি কোটিতে একটিবার হতো, এরকম প্রবাবিলিটি, কিন্তু হতই। কারোর জাদুদণ্ডে প্রানের সৃষ্টি না। প্রাণ আসলেই জটিল রাসায়নিক বিক্রিয়া। কিন্তু না হলো না, প্রফেসর উরের হিসেব সেদিন মেলেনি।
ঠিক তার পরের বছরই স্নাতক পড়তে প্রফেসর মুলারের (মিলার নন) কাছে এলেন সাগান। দেখা হলো প্রফেসর উরের সাথে। দুজনে মিলে প্রাণ সৃষ্টির উপর থিসিস ও লিখলেন।"
"দাঁড়াও দাঁড়াও, প্রফেসর উরে তো রসায়নবিদ ছিলেন, আর কার্ল সাগান তো পদার্থবিদ।"
"যাক একটা প্রাচীর আমাকে কষ্ট করে দেখাতে হলো না, তুই নিজেই সেটা এখনো বয়ে চলছিস, শোন তোর এই মনের প্রাচীর ভাঙতে হবে, তার জন্য রোজ দুবেলা দুপাতা কার্ল সাগান প্রেসক্রাইব করলাম।"
"ওরে বাবা, গল্পো বলা দাদু আবার ডাক্তার ও হয়ে গেল, যাই হোক, কেসটা বলো তো।"
"কেস হলো জেরার্ড কাইপার।"
"যার নামে কাইপার বেল্ট, তাই তো? উনি আবার কি করলেন?"
"কিছুই না, বসে বসে টেলিস্কোপ দিয়ে সৌরজগতের গ্রহ দেখতেন আর তাদের উপগ্রহ খুঁজতেন।"
"যেভাবে বলছো তাতে মনে হয় কোনো কাজই করতেন না!"
"আরে না রে, আসলে উনাদের নিয়ে কি বলবো, শুরু করলে তো কার্ল সাগানেই যাওয়া হবে না। স্যার নিউটন বলেছিলেন, উনি অন্যদের থেকে বেশি দেখতে পেয়েছেন কারণ উনি দৈত্যদের কাঁধে চড়ে বসে দেখেছিলেন। বুঝলি? হাবল, উরে, মিলার, কাইপার এরা সব সেই দৈত্য। যাদের কাঁধে বসে ডক্টর সাগান কসমস দেখেছিলেন। আর আমরা তো এই দৈত্যদের পায়ের তলায় বসে ডক্টর সাগান কি কি দেখলো তা শুনে যাচ্ছি।"
"ওকে ওকে বলো তাহলে জেরার্ড কাইপারের সাথে সাগানের গল্প!"
"একটু গল্পের মধ্যে গল্প হোক।"
"হোক।"
" শোন তাহলে,
প্রফেসর উরের ঘরে সদ্য স্নাতক পড়তে আসা সাগান ঢুকতেই দেখল, একপ্রকার বোমা হয়েই বসে আছেন উরে।
'কি ব্যাপার স্যার?' প্রশ্ন করলো কার্ল।
'ব্যাপার হলো লোকে নিজের চরকায় তেল দিতে যে কবে শিখবে?' বিরক্ত গলায় বলল উরে, 'যা ইচ্ছে তা বলে দেওয়া বিজ্ঞানে কাজ কি? রসায়নে নূন্যতম ধারণা না থাকলেও লোকে আজকাল রসায়নবিদ হয়ে যাচ্ছে। নতুন নতুন থিওরি দিচ্ছে। এইসব শখের রসায়নবিদদের জন্য রসায়নবিজ্ঞান আরো একশো বছর পিছিয়ে যেতে পারে সেটা বোঝো?'
'বুঝলাম স্যার, কিন্তু কোন নন-রসায়নবিদ রসায়নে থিওরি দিয়েছে সেটাই তো বুঝলাম না।'
'নাও পড়ে দেখো, পর্যবেক্ষক কাইপারের কাজ!', বলে একটা পেপার এগিয়ে দিলেন সাগানের দিকে।
পুরো পেপারটা পড়া হলে সাগান বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকলেন প্রসেফর উরের দিকে।
তারপর বললেন, 'স্যার উনি তো বলছেন মঙ্গল গ্রহে মিথেন আছে, আর সেখান থেকে মঙ্গলে প্রাণ সৃষ্টি হতেও পারে।'
'আরে সেটাই তো, তুমিই বলো এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? শেষ পাঁচ ছয় বছর ধরে এইসব আগডুম বাগডুম বলে যাচ্ছে। যত দেখছি এইসব লেখা আমার বিরক্তি আসছে লোকটার উপর। ভেবেছিলাম শুধরে গেছে। কিন্তু দেখছি না, পাগলামিটা সারে নি। এই তো গত বছর চাঁদের উপর গবেষণা করতে ওর একটু সাহায্য নিয়েছিলাম, তাতেই নিজেকে রসায়নবিদ বলে ভেবে নিয়েছে। আরে ভাই, তুমি টেলিস্কোপ নিয়ে তারা দেখছো, সেটাতে আমি নাক গলিয়েছি? কার পাশে কে ঘুরছে সেটাকে ঠিক ভুল কিছু বলেছি? তুমি কেন আমার বিষয়ে আসছো ভাই? নিজের চরকায় তেল দিলে সেটা যে বিজ্ঞানের জন্য মঙ্গল হবে সেটা বোঝাটাই তো একটা বিজ্ঞানীর কাজ।' একটু থামলেন প্রফেসর উরে, সদ্য স্নাতক পড়তে আসা তরুণের সামনে নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীর এইভাবে রিয়াক্ট করাটা ঠিক হলো কিনা বুঝতে চাইলেন, হাজার হোক, পর্যবেক্ষক হিসাবে কাইপারের নামডাক আছে, আর তার জন্যই উনি কাইপারের সাথে কাজে নেমেছিলেন।
'স্যার, বুঝলাম ব্যাপারটা উনার এক্তিয়ারের বাইরে, কিন্তু উনি ঠিক হলে মহাবিশ্বের ইতিহাস কিন্তু নতুন করে লিখতে হবে।' কার্ল সাগান যেন ভবিষ্যৎ থেকে কথাটা বললেন প্রফেসর উরে কে।
'তাহলে তুমিই লেখ, যাও ওর কাছ থেকে ঘুরে এসে লিখে ফেল কিভাবে প্রাণ সৃষ্টি হলো, আমার কাছে এসোনা আর বাপু, আমি বিজ্ঞানী, কল্পকাহিনীর লেখক না। লেখাটা লেখা হলে আসিমভকে দেখিয়ে নিও।' ফুট কাটলেন প্রবীণ প্রফেসর।
কলেজের গ্রীষ্মঅবকাশে সাগান চলে গেলেন কাইপারের কাছে। শুধুমাত্র মঙ্গল পর্যবেক্ষণ করতে। কিন্তু হলো না, আকাশ সাহায্য করলো না। মেঘ সরলোই না। সরলে কি হতো জানি না, কিন্তু না সরে ভালোই করলো। সারা অবকাশ গল্প করে কাটিয়ে দিলেন কাইপার আর সাগান। ব্রম্মান্ডের গল্প। ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্রতম তো বিশাল মহাবিশ্বের গল্প। আসলে তাই তো চেয়েছিলেন সাগান। কাইপারকে বুঝতে। একজন মহাকাশ পর্যবেক্ষক কিভাবে প্রাণ সৃষ্টির জটিল ব্যাপারে মাথা গলাচ্ছেন। প্রফেসর উরের ভাষায় এক্তিয়ার বহির্ভূত কাজ করছেন!
প্রফেসর জেরার্ড কাইপার
অবকাশের পর ফিরে এলেন কলেজে, প্রফেসর উরের থেকে দূরে দূরেই থাকলেন। একদিন কি একটা কাজে মুখোমুখি হয়ে গেলেন।
'কি ব্যাপার কার্ল? কাইপার কি মাথা খেয়ে নিল নাকি?'
'না স্যার, ভাবছিলাম যাবো আপনার কাছে। আমি একটা সমস্যা খুঁজে পেয়েছি। সমাধান ও আছে, তবে আপনাকে লাগবে।'
'সমাধানটা আদেও সমাধান কিনা সেটা আমি বুঝবো। আর জানতাম কাইপারের সমস্যা আছে।'
'না স্যার উনার না, সমস্যাটা সমগ্র বিজ্ঞানের।'
'কার? পদার্থবিজ্ঞান না রসায়ন নাকি বায়োলজির।'
'সবার।'
'কি সেটা?'
'স্যার, এরা কেউ আলাদা না। এদের মাঝে যে দেওয়ালটা তোলা আছে সেটাই সমস্যা। প্রানসৃষ্টির প্রাক্কালে বা বিগ ব্যাংর সময়ে আলাদা করে না পদার্থবিজ্ঞান ছিল, না রসায়ন ছিল। সবাই একসাথে ছিল স্যার। এই দেওয়াল অপ্রয়োজনীয়, ভাঙতে হবে সেই দেওয়াল স্যার। বিজ্ঞানকে এক ছাতার তলায় আনতে হবে।'
স্তম্ভিত হয়ে গেলেন নোবেলজয়ী, বলে কি ছোকরা? আমার রসায়নে নাক গলাবে একজন পদার্থবিদ বা একজন বায়োলজিস্ট? নাকি আমি এইসব ছেড়ে ক্যালকুলাসের কঠিন আঁক কষতে যাবো। 'কাল থেকে আমার কাছে তোমার আর আসার দরকার নেই, কার্ল, বিজ্ঞানের এই ছেলেখেলা আমি মানতে পারবো না'।
হাল ছাড়লেন না কার্ল। লেগে থাকলেন প্রফেসর উরের পিছনে। প্রতিনিয়ত যুক্তি দিয়ে বোঝাতে লাগলেন প্রফেসরকে। কাইপারের সাথে ঘনিষ্টতা বাড়লো। সাগানের ডক্টরাল এডভাইসর ও হলেন কাইপার।আমেরিকান স্পেস প্রোগ্রামের সাথে শুরু থেকেই যুক্ত ছিলেন সাগান। তার প্রবল প্রচেষ্টায় ভেঙে গেল বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে অদৃশ্য দেওয়াল। সব বিভাগের বিজ্ঞানীরা এসে এক ছাতার তলায় কাজ শুরু করলেন নাসার স্পেস প্রোগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যেতে।
কিন্তু আরো একটা প্রাচীর ছিল। হয়তো সবথেকে শক্তিশালী এটাই ছিল। বিজ্ঞান আর সাধারণ মানুষের মধ্যের প্রাচীর। বিজ্ঞানের অগ্রগতি যত বাড়ছিল, সাধারণ মানুষের মনে বিজ্ঞানের উপর ভয় তত বাড়ছিল, পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল অপবিজ্ঞান। চাঁদে পদার্পণ নিয়ে তাই তো এত জলঘোলা। সাগান বুঝলেন এটা ভাঙতে হবে, আর সেটাই হবে তার জীবনের একমাত্র উদেশ্য। কিন্তু কিভাবে বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবনে নিয়ে আসবেন বিজ্ঞানকে? বই? হতে পারে। কিন্তু বই এর বিকল্প চলে এসেছে মানুষের জীবনে তখন। টেলিভিশন। বই পড়া এক, আর চোখে দেখে কানে শুনে উপলব্ধি করা এক।
63 কোটি ডলার দিয়ে তৈরি করলেন 'কসমস-দি পার্সোনাল ভয়েজ'। পাশে পেলেন নিজের তৃতীয় জীবনসঙ্গীনি আন দ্রুইয়ানকে। পাবলিক ব্রডকাস্টিং সার্ভিস বা পিবিএস এ দেখানো হলো 13 এপিসোডের সেই এপিক 1980 সালে। সাগান তার কল্পনার জাহাজ ভাসিয়ে দিলেন কসমসের সমুদ্রে। পৃথিবীর প্রায় পঞ্চাশ কোটি মানুষ আজ অবধি তা দেখে ফেলেছে।
'যা কিছু অতীতে ছিল, যা কিছু বর্তমানে আছে, যা কিছু ভবিষ্যতে আসবে, তাই হলো কসমস' ঘোষণা দিলেন কার্ল সাগান। পরে এই টিভি সিরিজের গল্প নিয়েই লিখলেন, কসমস নামের বইটা।
আন দ্রুইয়ান
তবে সাবধানী ছিলেন কার্ল সাগান। যে বিপ্লব শুরু করলেন জানতেন তার বিরুদ্ধে বিজ্ঞানের তথাকথিত রক্ষীরা বাধা দেবেন। তাই হলো। কসমস টিভি সিরিজ যে বিজ্ঞান না, আদতে সায়েন্স ফিকশন সেটা প্রমান করতে তারা দেরি করলো না। কিন্তু ততদিনে দেরি হয়ে গেছে। আর সেই দেওয়াল তোলা গেল না। সাগান, ব্রুস মুরে আর লুইস ফ্রাইডম্যান তৈরি করলেন প্লানেটারি সোসাইটি। বিজ্ঞানকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। 1996 এ মাত্র 62 বছর বয়সে কসমসকে বিদায় জানালেন সাগান। তার আগে তৈরি করে গেলেন এমন এক প্রজন্ম কে যারা তার ব্যাটন বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। ব্যাটন না বলে হাতুড়িই বলা উচিত। বিজ্ঞান-বিজ্ঞানের মাঝের দেওয়াল, বিজ্ঞান-মানুষের মাঝের দেওয়াল আর মানুষ-পৃথিবীর মাঝের দেওয়াল ভেঙে দেওয়ার জন্য যার দরকার। আন দ্রুইয়ানের অনুপ্রেরণাতে ডক্টর নীল-ডিগ্রিস টাইসন 2011 2019 এ দুবার টিভিতে ফেরত নিয়ে এলেন কসমস কে, ডক্টর বিল মুরে প্রতিনিয়ত আমেরিকার স্পেস পলিসির এডভোকেসি করে যাচ্ছেন প্লানেটারি সোসাইটির হয়ে।"
"বাপরে!! জিনিয়াস তো উনি।"
"হ্যাঁ, জিনিয়াসই। প্রচুর বিজ্ঞান সাধক আসবে যাবে, তাদের বিজ্ঞানে কৃতিত্বও সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে। কিন্তু বিজ্ঞান শিক্ষক হতে পারবে কি?
কার্ল সাগান হতে পারবে কি?
হে, মহাপথের পথিক, তোমার হাতুড়ি আরো শক্তিশালী হোক, বোঝা না বোঝার মাঝের সব প্রাচীর ভেঙে দিও অকাতরে, এই উদ্ধত মানবকুলকে বারবার আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে মনে করিয়ে দিও, মহাশূন্যে ভাসতে থাকা হাল্কা-নীল বিন্দুতে কয়েক মুহূর্তের অতিথি ছাড়া আমরা আর কিছুইনা।"