আকাশে যে কটা তারা দেখা যায় তার ঔজ্বল্য যদি আমরা মাপি তাহলে দেখতে পাবো, বেশিরভাগ তারার ঔজ্জ্বল্যই সময় বিশেষে পরিবর্তিত হয়।
বৈজ্ঞানিক ভাষায় এর নাম এপারেন্ট ব্রাইটনেস বা আপাত ঔজ্জ্বল্য। আপাত কেন? পরে বলছি, আগে তারার এই ঔজ্জ্বল্য ব্যাপারটা একটু বুঝে নিই।
পৃথিবী থেকে যেকোনো মহাজাগতিক বস্তু, যাকে দেখা যায় (সে খালি চোখে হোক, বা এডভান্স মেশিন ব্যাবহার করে দেখা হোক), তাকে ঠিক কতটা ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে সেটাকেই ঔজ্জ্বল্য বলে। ঔজ্জ্বল্য মাপার স্কেলটা লগারিদম স্কেলে হয় আর মেরিট লিস্টের মতন সাজানো থাকে। মানে যার ঔজ্বল্য 'এক', সে 'দুয়ে'র থেকে বেশি উজ্জ্বল। কতটা উজ্জ্বল? না, প্রতি পাঁচ ঔজ্জ্বল্য স্কেলের ডিফারেন্সে ঔজ্জ্বল্যর পরিবর্তন হয় ১০০ গুণ। সহজভাবে বললে এক ঔজ্জ্বল্য বিশিষ্ট তারার থেকে ছয় ঔজ্জ্বল্যর তারাকে একশো গুণ কম আলো দিতে দেখা যাবে এই পৃথিবী থেকে।
লাইরা তারমণ্ডলীর উজ্জ্বলতম তারা হলো ভিগা। এই ভিগা তারার আপাত ঔজ্জ্বল্যকে 'শূন্য' ধরে মহাজাগতিক সমস্ত বস্তুর ঔজ্জ্বল্য পরিমাপ করা হয়। আকাশের সবথেকে উজ্জ্বল তারা হলো লুব্ধক বা ক্যানিস মেজর তারামণ্ডলীর সিরিয়াস। সিরিয়াসের আপাত ঔজ্জ্বল্য (-)১.৪৬। অর্থাৎ খালি চোখে দেখলে সিরিয়াসকে, ভিগার থেকে দেড় গুণ বেশি ভালো করে দেখা যায় পৃথিবী থেকে। কিন্তু যেহেতু এই ঔজ্জ্বল্য পরিবর্তনটা লগরিদ্মিক স্কেলে থাকে তাই ঔজ্জ্বল্যর পরিবর্তন এক্ষেত্রে ২.৫১২^১.৪৬ বা ৩.৮৬ গুণ হবে।
এর প্রধান কারণ মানুষের চোখ। আমরা সাধারনত যখন রোগা মোটা লম্বা এইসব বিশেষণ ব্যাবহার করে কিছু বলতে যাই তখন লগারিদম স্কেলেই ব্যাপারটার পরিমাপ করে থাকি।
সূর্যের আপাত ঔজ্জ্বল্য (-) ২৬.৮৩, পূর্ণিমার চাঁদের (-) ১২.৯০।
তারার এই ঔজ্জ্বল্য বা আলো তারার জ্বালানি থেকে আসে। জ্বালানী বলতে সাধারনত হিলিয়ামে পরিবর্তন হওয়ার জন্য তারার মধ্যে কতটা হাইড্রোজেন অবশিষ্ট আছে সেটাই বোঝায়। এই আপাত ঔজ্জ্বল্যর সাথে তারাদের পৃথিবী থেকে অবস্থানগত দূরত্বের একটা স্বাভাবিক সম্পর্ক আছে। সাধারণ বুদ্ধিতে বলে, যে বস্তু যত দূরে অবস্থিত তাকে ততই অস্পষ্ট দেখতে পাওয়া উচিত।
সেক্ষেত্রে যদি একদম একই জ্বালানির দুটো তারা পৃথিবী থেকে সম দূরত্বে অবস্থান করে তাহলে তাদের আপাত ঔজ্জ্বল্যও এক হবে, কিন্তু যদি তারা দুটো আলাদা আলাদা দূরত্বে অবস্থান করে তাহলে দূরত্বের পরিবর্তনের সাথে সাথে আপাত ঔজ্জ্বল্যরও পরিবর্তন হবে।
উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারে আমাদের সবথেকে কাছের তারা আলফা সেনটাউরী যা সেনটউরস তারামন্ডলে অবস্থিত এবং পৃথিবীর থেকে 4.37 আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত, সেটা আর সূর্যের ভর প্রায় সমান (আলফা সেনটাউরীর ভর মাত্র 1.08 গুণ বড়), কিন্তু আপাত ঔজ্জ্বল্যর হিসাবে দুজনের মধ্যে পার্থক্য সাড়ে ছাব্বিশ স্কেলের বা 40,000 কোটি (2.512^26.5) গুণ বেশি, যা সাধারণ হিসাবে বুঝতে মানুষের ব্রেনকে বেশ ভালোই কষ্ট করতে হবে।
আবার যদি আমরা কালপুরুষ তারামণ্ডলের দুই পায়ে অবস্থিত দুটো তারা রিগেল আর সাইফকে দেখি, তাহলে দেখতে পাবো দুটো তারাই পৃথিবী থেকে প্রায় সম দূরত্বে অবস্থিত হওয়া সত্বেও ভরের পার্থক্যের জন্য তাদের আপাত ঔজ্জ্বল্যর স্কেলে পার্থক্য 1.89।
এই সমস্যা মেটানোর জন্য আরো একটা স্কেলের ব্যাবহার করা হয়ে থাকে। এবসোলিউট ব্রাইটনেস স্কেল বা চরম ঔজ্জ্বল্য স্কেল। বাস্তবে কোনো তারার পৃথিবী থেকে দূরত্ব যাই হোক না কেন, এক্ষেত্রে 10 পারসেক বা 32.6 আলোকবর্ষের দূরত্বে সেই তারাকে রেখে তার ঔজ্জ্বল্যর পরিমাপ করা হয়ে থাকে। এই স্কেলে সূর্যের ঔজ্জ্বল্য 4.83 আর রিগেলের (-)6.69।
এই সমগ্র ব্যাপারটার সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ পার্ট হচ্ছে আমরা মানুষরা। অবশ্য যেকোনো বিষয়ে আমরা মানুষরাই সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ আমরাই হলাম দর্শক বা অবজারভার। মহাবিশ্বে কোনো কিছুরই কোনো মানে হয় না যদি না সেটার কোনো অবজারভার থাকে।
তো, শুধুমাত্র চোখের দেখা দেখেই এই তারাদের ব্যাপারে অনেক কিছু বলে দেওয়া সম্ভব হয়েছে মানুষের পক্ষে।
বেশিরভাগ তারার এই ঔজ্জ্বল্য নিয়মিত ভাবে পরিবর্তিত হতে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে প্রায় এক ব্রাইটনেস স্কেল অবধি ও পরিবর্তন হয়ে থাকে। ঔজ্জ্বল্যর এই পরিবর্তন অনেক ক্ষেত্রেই পৃথিবী থেকে খালি চোখে দেখা যায়। যেমন ধরুন, কালপুরুষ তারামণ্ডলীর কাঁধে অবস্থিত বিটেলজিউস। সময় বিশেষে এর আপাত ঔজ্জ্বল্য 0.1 থেকে 1.1 অবধি পরিবর্তিত হতে লক্ষ্য করা গেছে।
বিভিন্ন কারণে এই পরিবর্তন হয়ে থাকে। বিটেলজিউস এই মুহূর্তে রেড সুপারজায়েন্টে পরিবর্তিত হয়েছে। রেড সুপারজায়েন্টে পরিবর্তন হওয়া মানে মৃত্যুর দিকে এক কদম এগিয়ে থাকা। মৃত্যু এগিয়ে এলে সব প্রাণীর মতনই তারারাও আপ্রাণ চেষ্টা করে বেঁচে থাকার। সেই বেঁচে থাকার চেষ্টাতেই আপাত ঔজ্জ্বল্যর এই পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। আশা করা যায় আমাদের জীবদ্দশাতেই আমরা বিটেলজিউসের মৃত্যু দেখতে পারবো, যদিও সেটা আশা মাত্র। এই ধরনের মহাজাগতিক ঘটনার সাক্ষী হওয়া সবসময় সম্ভব হয়ে ওঠে না গড়ে পঁচাত্তর বছর বেঁচে থাকা একটা মানুষের পক্ষে।
আরো এক ধরনের পরিবর্তনশীল নক্ষত্র দেখা যায়। মহাবিশ্বে অধিকাংশ তারাই আমাদের সূর্যের মতন সিঙ্গেল তারা না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় দুটো তারা মিলে একটা সৌরজগত তৈরি করেছে। যেমন আলফা সেনটাউরী সৌরজগতে একসাথে তিনটে তারা অবস্থান করে। আলফা সেনটাউরী এ (রিজিল কেনতঔরস), আলফা সেনটাউরী বি (টলিমান) এবং আলফা সেনটাউরী সি (প্রক্সিমা সেনটাউরী)। এই তিনটে তারা পরস্পরকে কেন্দ্র করে ঘোরে, তাই পৃথিবী থেকে যখন আমরা দেখি তখন দূরত্বের জন্য খালি চোখে তিনটেকে একটা তারাই মনে হয় আর সেটার আপাত ঔজ্জ্বল্য তারাগুলোর অবস্থানের উপর নির্ভর করে। পৃথিবী থেকে দেখার সময় যদি তিনটে তারা এক লাইনে থাকে তাহলে স্বাভাবিক ভাবেই ঔজ্জ্বল্যর পরিমাণ সব থেকে বেশি থাকবে। আবার যখন সেগুলো এক লাইনে থাকবে না তখন ঔজ্জ্বল্যর পরিমাণ কমে যাবে।