খসড়া প্রকাশনীর বইমেলা 2024 সংখ্যায় প্রকাশিত
নিজের চেয়ারে এসে বসেই মোবাইলটা টেবিলে একপ্রকার ছুঁড়ে ফেললো বিজপুর থানার এস-আই সৈকত পাল। ওসি রাহুল সেন এখনো ডিউটি জয়েন করতে পারেনি তাই অফিস সামলাতে হচ্ছে সৈকতকেই।
সৈকত এইমাত্র ব্যারাকপুর থেকে থানায় ফিরলো। সেশন কোর্টে যেতে হয়েছিলো একটা ওপেন এণ্ড শাট কেসের তদন্তকারী অফিসার হিসাবে। খুনের আসামি হিসাবে যে অভিযুক্তকে এখনো পুলিশ কাষ্টডিতে ধরে রেখেছে ও, তার বেলের শুনানি ছিল আজ।
“স্যার…আসতে পারি?” পরিচিত গলার স্বরটা শুনে চোখ তুলে দরজার দিকে তাকালো সৈকত।
ভদ্রলোককে দেখে আরো মুশরে পড়লো ও। মাস খানেক আগেই লোকটার সতেরো বছর বয়সী ছেলে প্রাঞ্জলকে বাড়ির সামনে গুলি করে খুন করেছে ছেলেরই এক বন্ধু বিশাল, প্রেম ঘটিত কেসে। সিজেএম কোর্টে প্রথমবার বেলের আবেদন নাকচ হওয়ার পর বিশালের এডভোকেট এবার সেশন কোর্টে বেলের আবেদন করেছিল, আর আজ সেটার রায়দান হওয়ার কথা ছিল। সৈকত বজ্র আঁটুনি দিয়ে কেস ফাইলটা বেঁধে রেখেছিল, ছেলেদুটোর মাঝে থাকা মেয়েটার সাক্ষ্য, তিনজন প্রত্যক্ষদর্শীর জবানবন্দী, প্রাঞ্জলের মোবাইল ফোনের কল রেকর্ড সহ বেশ কিছু ভয়েস রেকর্ডিং ছিল ওর ফাইলে। কিন্তু ফস্কা গেরো হয়ে গেল একটা প্রাইভেট নার্সিংহোমের রেকর্ড।
আসামি মানে বিশাল নাকি খুনের সময় কল্যাণীর একটা হাসপাতালের বেডে শুয়ে স্যালাইন নিচ্ছিলো লুজ মোশনের ওষুধ হিসাবে। হাসপাতাল রেকর্ড, একজন নামকরা চিকিৎসকের সাক্ষ্যর সামনে পুলিশের কাগজপত্রগুলোর ধার ভোঁতা হয়ে গেছে বিচ্ছিরি ভাবে। তবে, আশার কথা একটাই, আদালত এখনো বেল দেয়নি, পুলিশ কাষ্টডির মেয়াদ শেষ হচ্ছে তিন দিন পরে, ওইদিনই রায়দান হবে। তিনদিনের মধ্যে পুলিশ যদি নতুন কিছু সাক্ষ্যপ্রমাণ যোগাড় না করতে পারে তাহলে ছেলেটাকে ছেড়ে দিতে হবে, কারণ বেল আটকানোর মতন প্রমাণ পুলিশের হাতে নেই সেটা জলের মতন পরিষ্কার। বেলের পর অবশ্য নতুন করে আবার খুনের তদন্ত শুরু করতে হবে কিন্তু সৈকত জানে সেসব করে কোনো লাভ নেই।
খুনটা যে বিশালই করেছে তা সারকামস্ট্যানন্সিয়াল এভিডেন্সে পরিষ্কার। শুধু তাই না, অভিযুক্ত বিশাল সুর নামের ছেলেটা পুলিশের সামনে সেসব কথা স্বীকারও করেছিল প্রাথমিক তদন্তের সময়। কিন্তু যেহেতু আদালতের সামনে পুলিশি জেরার সময় বলা কথা প্রমাণ হিসাবে গৃহীত হয় না তাই বিশালের সেইসব স্টেটমেন্টের কোনো গুরুত্ব নেই সেটা সৈকত জানে। আর আরো ভাল করে জানে যে বিশালকে সাজা না দিতে পারলে এই কেসকে সম্পূর্ণ ভাবে শাটডাউন করে দিতে হবে।
প্রাঞ্জলের বাবা নারায়ণ বিশ্বাস এসে বসলো সৈকতের সামনে, ভদ্রলোকের চোখের কোণে জল দেখা যাচ্ছে। অনেক আশা নিয়ে আদালতে গেছিলেন পঞ্চাশ পেরিয়ে যাওয়া সফ্টওয়ার ইন্ঞ্জিনিয়ার নারায়ণবাবু। কিন্তু পয়সার সামনে জাস্টিসকে খোরাক হতে দেখে বেরিয়ে এসেছিলেন আদালত থেকে।
“সরি, দাদা। একটা প্রাইভেট নার্সিংহোমকে ঐভাবে টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে নেবে ওরা এটা আমি ভাবতে পারিনি।” সৈকত হেরে যাওয়া আওয়াজে বললো।
“ইট্স ওকে! ছেড়ে দিন কোর্টের কথা, আমি এখন ঐ ব্যাপারে কথা বলতে আসিনি স্যার। একটা অন্য ব্যাপারে কথা বলব বলে এলাম।” নারায়ণবাবুর গলা ভেজা হলেও অদ্ভুত একটা দৃঢ়তা নিয়ে ভদ্রলোক কথাটা বললেন।
“ওহ! বলুন। কি বলতে চান?” একটু অবাক হলো সৈকত।
“বিশালের সাথে একবার দেখা করা যাবে?”
“বিশাল এখন মেডিক্যাল চেকাপের জন্য জেএনএম হাসপাতালে আছে। যদিও মিনিট দশেকের মধ্যেই চলে আসবে। কিন্তু ওর উকিলের উপস্থিতি ছাড়া তো আপনি ওর সাথে কথা বলতে পারবেন না। “
“ওহ!” ভদ্রলোক একটু কষ্ট পেলেন যেন, “কোনোভাবেই কি সম্ভব না? ধরুন মিনিট পাঁচেকের জন্য?”
সৈকত একটু ভাবলো, তারপর বললো, “ঠিক আছে। আপনি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন, ওকে জেলে ঢোকানোর আগে আমার ঘরে একবার ডাকতে হবে, কিছু পেপারওয়ার্ক আছে। তখন না হয় আপনি এখানেই কথা বলে নেবেন। তবে উইটনেস হিসাবে আমার এক কনস্টেবল থাকবে। আর কি ধরনের প্রশ্ন করবেন সেটা কি আমাকে বলা যাবে?”
“আসলে, এখনো ভাবিনি কি বলবো। আমার তো সব শেষ হয়েই গেল, মনে তো হয় না কেসটা আমরা আর জিতবো, তাই একবার কথা বলতাম ওর সাথে। একটা মেয়ের জন্য ছোটবেলার বন্ধুর প্রাণ নেওয়ার জন্য ঠিক কতটা অমানুষ হতে হয় সেটাই বোঝার চেষ্টা করবো।”
কিছু না বলে ভদ্রলোকের দিকে একটু তাকিয়ে থাকলো সৈকত। তারপর বললো, “বেশ! এইটুকু অবশ্যই করে দেব আপনার জন্য। আমিও মানতে পারছি না বিশালের জিতে যাওয়াটা।”
“থ্যাঙ্কস! আচ্ছা ও যেটা বলবে সেটা কি রেকর্ড করে রাখতে পারি? মানে ভিডিও করে রাখতে পারি কি?”
“না না! একদমই ওসব করতে যাবেন না। এমনিতেও ওসব করে লাভ নেই। থানায় বসে জবানবন্দির ভ্যালু নেই।”
“আচ্ছা সে ঠিক আছে, ভিডিও করলাম না। তবে আমি কিন্তু কোর্টে প্রমাণ দেখানোর জন্য করতাম না, নিজের কাছে রেখে দিতাম শুধু। আরো একটা কথা বলার ছিল, ঐ যে কনস্টেবল থাকবেন তাকে একবার ডাকা যাবে।”
অনুরোধটা উটকো হলেও সৈকত সেটা মেনে নিলো। তিন চারবার বেশ জোরে কনস্টেবল প্রভাত রায়কে ডাকলো। প্রভাত চেম্বারে এলে ওকে সব বুঝিয়ে দিয়ে সৈকত দুজনকেই বিদায় করলো ঘর থেকে।
মিনিট পনেরো পরে পুলিশের ভ্যানটা ফিরে এলো বিজপুরে। থানায় ফিরেই হুংকার দিতে শুরু করে দিলো ছেলেটা। পুলিশি তদন্তকে যেভাবে হাসির পাত্র বানিয়ে দিয়েছে সেটাই জোরে জোরে শোনাতে লাগলো।
প্রভাত বিশালকে নিয়ে ঢুকলো সৈকতের চেম্বারে। বিশাল তখনো হাত পা ছুঁড়ে আনন্দ করে যাচ্ছে।
“এই গান্ডু! অনেক হয়েছে তোর নাচ। বেরিয়ে হয়তো যাবি এখান থেকে, তারপর কিন্তু তোর সাথে অনেক কিছু হতে পারে রাস্তা ঘাটে। সেইসব ভেবে তারপর নাচনাচি কর।” সৈকত পুরো পুলিশের গলায় ধমক দিলো।
বিশাল চুপ করে গেল, সৈকত এবার নারায়ণবাবুকে দেখিয়ে বললো, “ইনি তোকে কিছু বলতে চান। যা যা প্রশ্ন করবে সেগুলো সত্যি বলে দিস।”
একটা চেয়ারে বিশালকে বসিয়ে অন্য চেয়ারে নারায়ণ বাবুকে বসতে বলে নিজের চেয়ারে বসতেই একটা আননোন নম্বর থেকে ফোন এলো সৈকতের। ফোনটাতে কয়েক সেকেন্ড কথা বলে ফোনটা কেটে দিয়ে কনস্টেবল প্রভাতকে পাহারায় রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো সৈকত।
“আপনি ভিডিও রেকর্ড করবেন বলেছিলেন না, নারায়ণবাবু?” প্রশ্ন করলো সৈকত।
“হ্যাঁ, স্যার।”
“ঠিক আছে, করতে পারেন। আমি মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই আসছি ফিরে। আর প্রভাত তুমি ততক্ষণ ব্যাপারটা খেয়াল রাখবে।”
“রেকর্ড করে কি ছিঁড়বেন? কোর্ট তো নেবেনা ওগুলো।” সৈকতকে চলে যেতে দেখে ফুট কাটলো বিশাল।
“রেকর্ড করে সেগুলো তোর পিছন দিয়ে ঢোকাব, বুঝলি শুয়রের বাচ্চা।” কথাটা বলে সৈকত চলে গেল।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দুজনের কথা শুনতে লাগলো প্রভাত। নারায়ণবাবু যখন এফআইআর করতে আসে তখন সেটা প্রভাতই লিখেছিল, তাই কেসটা ও প্রথম থেকেই জানে।
পুলিশের চাকরিতে প্রচুর আসামি দেখলেও বিশালের মতন শুয়োরের বাচ্চা আর একটাও দেখেনি প্রভাত, ছেলেটাকে তাই একটু ঘৃণাই করে ও। বস্তুত সেইজন্যই ওদের আশেপাশে না থেকে গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে প্রভাত কারণ এই কেস নিয়ে আর বিন্দুমাত্র উৎসাহ নেই ওর।
কিন্তু কথা শোনার ইচ্ছে না থাকলেও টুকটাক কিছু কথা কানে আসছিল প্রভাতের, পুলিশের চাকরি করে কানটা বেশ মজবুত ওর। নারায়ণ বিশ্বাসকে বেশ তাচ্ছিল্যই করছিল বিশাল, সেটা বুঝতে পেরে প্রভাতের মাথাটা আরো গরম হয়ে যাচ্ছিলো।
হঠাৎ করেই প্রভাতের মনে হলো সৈকত ওকে ডাকছে! একটু আশ্চর্য হলো ও, পাহারার দায়িত্ব যখন ওকে দিয়েছে, তখন তো সৈকতের ডাকার কথা না প্রভাতকে! দরজার পর্দা সরিয়ে বাইরে উঁকি মেরে বুঝলো থানার পিছনের দিক থেকে ডাকটা আসছে। সৈকত সত্যিই প্রভাতকে ডাকছে। ‘প্রভাত’, ‘প্রভাত’ করে ডেকেই যাচ্ছে! ঘরের ভিতরে একবার তাকিয়ে দেখলো ডাকটা নারায়ণবাবু আর বিশালও শুনেছে।
“আপনারা এখানেই বসে থাকবেন, আমি একটু শুনে আসছি।” বলে প্রভাত বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। আসামি যে পালাবে না সেই ব্যাপারে ও শিওর ছিল, কারণ জেতা কেসে পুলিশ হেফাজত থেকে পালিয়ে গিয়ে সেটাতে হেরে যাওয়ার মতন গান্ডু যে বিশাল না সেটা প্রভাত জানে।
কিন্তু থানার পিছনে গিয়ে প্রভাত যা দেখলো তাতে ওর মনে হলো ওকেই কেউ গান্ডু বানিয়েছে। কারণ থানার পিছনে একটা ভাঙ্গা চেয়ারের সিটের উপরে একটা ছোট মোবাইল ফোন রাখা আছে যেখান থেকে আওয়াজটা আসছে যাতে করে মনে হচ্ছে সৈকত প্রভাতকে ডাকছে। ফোনটা হাতে নিয়ে রহস্যটা ক্লিয়ার হলো ওর। একটা নম্বর থেকে ইনকামিং কল আসছে ফোনটায়, আর ফোনটার রিংটোন সেট করা আছে প্রভাতকে সৈকত ডাকছে এরকম একটা শব্দ।
ব্যাপারটাকে মগজে নিতে বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল প্রভাতের। তারপর ফোনটা রিসিভ করলো ও। রিসিভ করে কানে নিতে না নিতেই ফোনটা কেটে গেল, কিন্তু আর কোনো ফোন এল না। যে নম্বর থেকে ফোন আসছিল সেটাতে কল ব্যাক করলো প্রভাত, কিন্তু নম্বরটা অফ পেল! ব্যাপারটার একফোঁটাও বুঝতে না পেরে থানার সামনে এসে আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা কলিগদের ডেকে ফোনটা দেখালো প্রভাত।
মিনিট খানেক পরে ওর খেয়াল হলো ওর পাহারার কথা। এই ইয়ার্কিটা কে করেছে সেটা নিয়ে পরে ভেবে দেখবে ঠিক করে সৈকতের চেম্বারে ঢুকলো প্রভাত। আর ঢুকেই যা দেখলো তাতে ওর রক্ত জমে বরফ হয়ে গেল। নারায়ণ বিশ্বাস ঘরে নেই আর যে চেয়ারে বিশালকে বসিয়ে রেখেছিল ও সেই চেয়ারেই বিশাল বসে আছে কিন্তু ওর বুকের বাঁ দিকে একটা ছুরি ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে। বেশিক্ষণ আগের কেস না, কারণ ছুরি থেকে চুঁয়ে চুঁয়ে গাঢ় লাল রক্ত তখনও বুক থেকে বেরিয়ে আসছে।
**মাস খানেক পরের কথা**
এবার ব্যারাকপুর সেশন কোর্ট থেকে বকা খেয়েই ফিরতে হয়েছে ওসি রাহুলকে। কর্তব্যে গাফিলতির তদন্ত চলছে সৈকত আর প্রভাতের নামে।
তবে বিশালের বেল কেসে কথা শুনে যতটা মন খারাপ হয়েছিলো, নারায়ণ বিশ্বাসের বেলের রায়ে ততটা খারাপ লাগেনি সৈকতের। আসলে নারায়ণ বিশ্বাসের হাতে বিশালের খুনটা সৈকতের কাছে ন্যাচারাল জাস্টিসের মতন মনে হয়েছিলো। তবে ওর খারাপ লেগেছিল যে নারায়ণবাবু খুনটা থানায় করেছিল বলে। তাতে পুলিশ ডিপার্টমেন্টের ভাবমূর্তির যে ক্ষতি হয়েছে সেটা মানতে একটু কষ্ট হচ্ছিল।
রাহুল ফিরতেই ওর ঘরে ঢুকে পড়লো থানার প্রায় সব স্টাফ। সবাই এসেছে কোর্টে কি হলো সেটা ডিটেলসে জানতে।
“স্যার, এত বড় একটা প্রমাণ থাকতেও নারায়ণ বিশ্বাস নিরপরাধ প্রমাণ হয়ে গেল?” প্রথমেই প্রশ্ন করলো সৈকত।
“হুম! ভিডিওটা ফেক বলে প্রমাণিত হয়েছে আদালতে।” রাহুল বললো।
“সে কি করে সম্ভব! ক্যামেরায় তোলা ভিডিও ফেক কি করে হতে পারে!” কনস্টেবল প্রভাত বিস্ময় প্রকাশ করলো, যার উপর সেদিনের পাহারার দায়িত্ব ছিল।
“ভুলটা তো তুমি করে ফেলছো ভাই, সেদিন তুমি ঘর থেকে না বেরিয়ে গেলে এসব কিছুই হতো না।”
“কিন্তু স্যার, আপনি তো জানেন যে আমি কেন ঘর থেকে বেরিয়ে গেছিলাম। ঐভাবে সৈকত স্যারের ডাক শুনে…”
“লোকটাকে প্রণাম করতে ইচ্ছে করছে জানো প্রভাত! ভাবো, সৈকতকে দিয়ে তোমাকে ডাকা করিয়ে সেই ডাক রেকর্ড করে, সেটাকে মোবাইলের রিংটোন বানিয়ে ফোনটাকে ওরকম একটা জায়গায় লুকিয়ে রাখলো লোকটা। আর সবটাই ডিপার্টমেন্টের চোখের সামনে হলো।” একটু হতাশ গলায় বললো রাহুল।
“ভুলটা আমারই!” সৈকত বললো।
“আপনি বেকার নিজেকে ব্লেম দিচ্ছেন স্যার। সেদিন আদালতে আপনাকে যা যা শুনতে হয়েছিলো তাতে আপনি যে বেশ আপসেট হয়ে পড়েছিলেন সেটা আপনাকে যে কেউ দেখেই বুঝতে পারতো। লোকটা সেটারই সুযোগ নিয়েছিল। তারপর দেখুন, আপনাকে যেন আপনার চেম্বার ছেড়ে বাইরে যেতে হয় তার জন্যও একটা ফেক কলের ব্যবস্থা করে রেখেছিল লোকটা। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো, উনি তো ক্যামেরার সামনেই খুনটা করলেন, সেটা তো রেকর্ডেড! সেটা ফেক প্রমাণ হলো কিভাবে?”
রাহুল একটু হাসলো, তারপর সবার দিকে একবার দেখে সবার উদ্দেশ্যেই একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো, “মানুষের হাতে কটা আঙুল থাকে জানো?”
প্রশ্নটা শুনে উপস্থিত লোকজনের মুখের অবস্থা এক একরকমের হলো।
কোনো উত্তর এলো না দেখে রাহুল এবার প্রভাতের উদ্দেশ্যে বললো, “আরে জানো না নাকি মানুষের হাতে কটা করে আঙুল থাকে? এই উত্তর দিতে এত সময় লাগছে কেন?”
“সে তো জানি স্যার। দশটা করে আঙুল থাকে। কিন্তু এরকম প্রশ্ন করলেন হঠাৎ।” প্রভাত চটজলদি উত্তর দিলো।
“দশটা তো স্বাভাবিক মানুষের থাকে। কিন্তু অস্বাভাবিক মানুষের কটা করে থাকে জানো?”
“ঋত্বিক রোশনের তো এগারোটা আঙুল স্যার!” অন্য একটা স্টাফ উত্তর দিলো।
“হ্যাঁ। সেরকম অনেকেরই হয়। কিন্তু এই নারায়ণ বিশ্বাসের ক্ষেত্রে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। আমাদের রেকর্ড বলো, কি ফিজিক্যাল ভেরিফিকেশন বলো সবেতেই লোকটার দুহাত মিলিয়ে দশটা আঙুলই আছে। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে যে ভিডিওটাতে আমরা প্রোডিউস করেছি, সেটাতে ওর হাতে বারোটা আঙুল দেখা যাচ্ছে!”
কথাটা ঘরের মধ্যে একটা গুঞ্জন তৈরি করলো। রাহুল চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে সবার দিকে দেখতে লাগলো।
“সে কি করে সম্ভব স্যার? যার হাতে দশটা আঙুল আছে, তার ভিডিওতে বারোটা আঙুল আসবে কি করে?” গুঞ্জন নামের একজন কনস্টেবল বলল।
জয়িতা বললো, “ভিডিওটা তো আমরা সবাই দেখেছি, কিন্তু তাতে তো…”
“সেটাই তো সবথেকে বড় মিসটেক করেছি আমরা। ভিডিওটা ভালো করে না দেখেই ওটাকে প্রমাণ হিসাবে আদালতে দাখিল করেছি।” রাহুল বললো।
“কিন্তু ওর হাতে বারোটা আঙুল দেখা যাচ্ছে বলে ভিডিওটা প্রমাণ হিসাবে কোর্ট নিলো না?” প্রভাত প্রশ্ন করলো।
“না নিলো না” রাহুল বললো, “কোর্ট ভিডিওটাকে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সি দিয়ে বানানো বলে মেনে নিয়েছে। কারণ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সি নাকি মানুষের হাত ঠিক মতন বানাতে পারে না। অনেকক্ষেত্রেই দেখা গেছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সি দিয়ে বানানো ছবিগুলো অন্য সব ব্যাপারে নিখুঁত হলেও হাতের ব্যাপারে ওরা একদমই অপরিপক্ক। আর সেটারই সুবিধা নিয়েছে সফ্টওয়ার ইঞ্জিনিয়ার নারায়ণ বিশ্বাস!”
“এক্সট্রা দুটো আঙুল কি উনি তাহলে আলাদা করে লাগিয়ে এসেছিলেন?” জয়িতা যেন কিছু একটা ভেবে বললো।
“হ্যাঁ, ওরকম কিছু একটা হবে। নইলে হঠাৎ করে তো আর দুটো আঙুল গজায়নি তাই না?” কথাটা শেষ করে উঠে দাঁড়ালো রাহুল। ওকে উঠে দাঁড়াতে দেখে বাকিরাও ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
**খুনের দিন সকালে**
“আরে নারায়ণদা.. কি খবর বলো.. হঠাৎ করে এদিকে.. আজ তো তোমার ছেলের.. মানে..”
“হ্যাঁ, আজ বাবিনের খুনের কেসটা কোর্টে উঠবে। বিশাল বেলের জন্য আবেদন করবে।”
“সে যা খুশি করুক.. জিতবে তো তুমিই। সত্য সর্বদা জয়ী হয়, দেখো!”
“না রে ভাই, মনে হয় না ওরকম কিছু হবে। কাল রাতেই জেনে গেছি আজ কি হবে। ভারতী নার্সিংহোমকে টাকা খাইয়ে ওরা অলরেডি বিশালের এলিবাই তৈরি করে রেখেছে। বেল পেয়ে যাবে ও, আর আমার ছেলেটা বিচার পাবে না!”
“না না দাদা ওরকম করে বলো না। ঠিক বিচার হবে, মানুষের দরবারে না হোক এই আমার মায়ের দরবারে ঠিক বিচার হবে দেখো।”
“হ্যাঁ! সেই জন্যই তো তোর কাছে এলাম। আমাকে দুটো জিনিস বানিয়ে দিতে পারবি ভাই? একটু জলদি বানাতে হবে, আজই।”
“হ্যাঁ, কেন পারবো না দাদা! আমার আজ সেরকম কাজ নেই, হাত ফাঁকাই আছে। তুমি শুধু বলো কি বানাতে হবে? ঠাকুরের আশীর্বাদে তো জানোই আমার হাতে মাঝে মাঝে বিশ্বকর্মা স্বয়ং এসে বসে! আজ যদি উনি এসে বসেন তো..!”
“বসবেন, বসবেন! ঠিক এসে বসবেন। বিশ্বকর্মাকে আজ আসতেই হবে। ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে নিষ্ঠা ভরে এত বছর উনার পুজো করেছি। আজ ভক্তের ডাকে সাড়া উনাকে দিতেই হবে।”
“ইয়ে! মানে বানাতে কি হবে দাদা?”
“আমার দুহাতে লাগানোর জন্য দুটো আঙুল! আর সেটা আমার হাতে লাগানোর জন্য একটু ব্যবস্থা করে দিবি জাস্ট! ঐ ধর একটা রিং টাইপের বানিয়ে দিবি নিচের দিকে যাতে হাতে পরলে বোঝা না যায় ওটা মাটির প্রপ।”
বিজপুরের বিখ্যাত মৃৎশিল্পী রমাপদ মণ্ডল কথাটা শুনে একটু অবাক হলেও কাজটা করার সিদ্ধান্ত নিলো। একঘণ্টার মধ্যেই নারায়ণ বিশ্বাসের হাতের রংয়ের সাথে রঙ মিলিয়ে বানিয়ে দিলো দুটো প্রমাণ সাইজের আঙুল। আঙ্গুল দুটো হাতে সেট হওয়ার পর নারায়ণ বিশ্বাসের মনে হতে লাগলো জন্ম থেকেই উনি বারোটা আঙুল নিয়েই বড় হয়েছে। প্রকাশ্যেই রমাপদর তারিফ করে আঙুলদুটো খুলে নিয়ে সেটা একটা সেফ প্যাকেটে ভরে পকেটে নিয়ে নিলো নারায়ণবাবু। আদালতের রায় অবধি অপেক্ষা করতেই হবে ওকে!
তারপর যদি সব ঠিক-ঠাক মিটে যায় তাহলে সন্ধ্যের সময় রাসমনি ঘাটে গিয়ে গঙ্গায় বিসর্জন দিয়ে দেবে আঙুলদুটোকে এই ভেবে ব্যারাকপুরের উদ্দেশ্যে গাড়ি ছোটালো ভদ্রলোক।