হঠাৎ করে গাড়িটাকে রাস্তার মাঝখানে দাঁড় করিয়ে দিলো পাপান। ইউটিউবে অডিও স্টোরি শুনতে শুনতে ড্রাইভ করাই ওর নেশা। ওর পেশাটাই হলো ড্রাইভ করা, সরকারি একটা দপ্তরের আধিকারিকের গাড়ি চালায় পাপান। আজ অবশ্য ঐ আধিকারিককে এয়ারপোর্ট থেকে আনতে যাচ্ছে একাই। অডিও স্টোরি শুনতে শুনতে বেশ কিছুক্ষণ পর পর যে বিজ্ঞাপন আসে, সেটা মাঝে মাঝেই বড্ড বিরক্তিকর হয়ে যায়। দুর্দান্ত একটা ব্যোমকেশের গল্পের মাঝে ফুড ডেলিভারি বা সোশ্যাল সাইটের বিজ্ঞাপন গল্পের মুড নষ্ট করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
তবে বেশ কিছুদিন ধরে একটা বিজ্ঞাপন ওকে মানসিকভাবে খুব বিরক্ত করছে। হঠাৎ করেই পাঁচ সেকেন্ডের একটা সুর। কিছু বোঝার আগেই শেষ হয়ে যায়। যখন শুরু হয়, হটাৎ করেই মাথাটায় কে যেন হাতুড়ি পিটিয়ে দেয়। প্রথম যেদিন শুনেছিল, পাপান বুঝতে পারেনি কি হচ্ছে ওর শরীরে। হটাৎ করেই একটা গল্পের মধ্যে বিজ্ঞাপন এসেছিল, ফোন দেখতে পায়নি বলে সুরটাকে গল্পের আবহ সঙ্গীত বলেই ভেবে নিয়েছিল। সুরটা কোন চেনা সুর না, পাঁচ সেকেন্ডের একটা খুব উঁচু স্বরে বাঁধা সুর। অনেক ধরনের গল্প শোনে বলে পাপান জানে, গল্পের মধ্যে নাটকীয়তা আনতে চ্যানেলগুলো অনেক রকম শব্দ ব্যাবহার করে, যা মাঝে মাঝেই শরীরের সব রোমকে খাঁড়া করে দেয়।
আর মাথা ব্যথাটাকেও সেরকম পাত্তা দেয়নি পাপান। গাড়িটা নিয়ে রাস্তাটা পেরিয়ে যাওয়ার পর সামনের একটা ধাবাতে দাঁড়িয়ে দেখে গাড়ির সামনে চাপ চাপ লাল রং লেগে আছে।
সেদিন অতটা বুঝতে পারেনি কি হয়েছিল, তবে তারপর থেকে সেই সুর আর তার ফলে তৈরি হওয়া মাথা যন্ত্রণা পাপানের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। তবে একটা জিনিষ প্রতিবারই হয়েছে, সেটা হলো গাড়ির সামনের লাল রং। জল দিয়ে ধুলেই অবশ্য চলে যায়। তবে যখন ঐ মাথা যন্ত্রণা করে খুব ইচ্ছে করে সামনে কেউ এলে তাকে পিষে দিতে। পাঁচ সেকেন্ড পরেই যখন মাথা ঠিক হয়ে যায়, নিজের এই ভাবনার জন্য নিজেকেই থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে করে পাপানের। অনেকদিন ধরেই গাড়ি চালাচ্ছে ও, আজ অবধি একটা এক্সিডেন্ট ও করেনি। এই ব্যাপারে নিজের উপর রীতিমত গর্ব আছে পাপানের।
আজ সুরটা শুরু হওয়ার সাথে সাথেই পাপান গাড়িটা থামালো রাস্তার ধারে। সিগন্যাল না দিয়েই বাম দিকে গাড়িটা দাঁড় করাল ও। পাশ থেকে একটা গাড়ি বেরিয়ে যাওয়ার সময় চারটে গালাগাল দিয়ে গেলো। আর দেবে নাই বা কেন? রাস্তার প্রায় মাঝ বরাবর গাড়িটা ছিল, যখন হটাৎ করেই পাপান ওটাকে বাম দিকে নামিয়ে দেয়। কল্যাণী এক্সপ্রসওয়েতে সোদপুর পেরিয়ে দমদমের দিকে বেশ কিছুটা এগিয়ে এখন গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে।
গাড়িটা দাঁড়ানোর সাথে সাথেই গাড়িতে বসে মোবাইলটা হাতে নিলো পাপান। আজ ও দেখেই ছাড়বে এটা কিসের বিজ্ঞাপন। মাথাটা ফেটে যাচ্ছে যন্ত্রণায়, তাও বিজ্ঞাপনটা পজ করতে পেরেছে।
স্ক্রিনের দিকে তাকালো, ভিডিওটা ব্ল্যাঙ্ক, পজ বটনটা আর 'ভিডিও এই বিজ্ঞাপনের পর পুনরায় চালু হবে' এই দুটো ছাড়া কোনো কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বিজ্ঞাপনটা যেন না দেখা যায়, তাই সাথে সাথে ইউটিউব এপ্লিকেশনটাকে বন্ধ করে দিলো।
গাড়ি থেকে নেমে সামনে দেখতে গেলো, অবাক হওয়ার মতন কিছুই ছিল না, আবার সেই লাল রং ফিরে এসেছে। ওটাকে জল দিয়ে ধুয়ে দিলো পাপান। তারপর নিজের চোখে মুখে জল দিলো, মাথা ব্যাথা অনেকটাই কমে এসেছে।
না, এবার একটা ডাক্তার দেখাতেই হবে, পাপান ভাবলো, কিন্তু কিসের ডাক্তার দেখাবে?
পাপান স্কুল লাইফে বিজ্ঞানের বেশ ভালোই ছাত্র ছিল, পেটের দায়ে গাড়ি চালাতে হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু ওর মনে কোনো কুসংস্কার নেই। সমস্যাটা যে মনের সেটা স্পষ্টই বুঝতে পারছে। তাই মনের ডাক্তারের কাছেই যেতে হবে। তাতে বিশেষ অসুবিধা নেই। কিন্তু গিয়ে কি বলবে? বিজ্ঞাপনটা তো হটাৎ করে আসে, পরে অনেক খুঁজেও ও পায়নি।
কিন্তু এর সমাধান ইমিডিয়েট না পেলে তো ওকে পাগল হয়ে যেতে হবে, নইলে কাউকে হয়তো সত্যিই গাড়ি চাপা দিয়ে দেবে। তাছাড়া ওই লাল রংটা কোথা থেকে আসছে সেটাও তো একটা আশ্চর্যের বিষয়।
একটা সিগারেট ধরিয়ে এইসব ভাবছিলো। ফোনটার দিকে দেখতেও ইচ্ছে করছে না এই মুহূর্তে পাপানের।
তবে অডিও স্টোরি না শুনলে এই বিজ্ঞাপনটাও আসেনা, এটা পাপান লক্ষ্য করেছে, তাই গান জাতীয় জিনিস শুনলে কোনো সমস্যাও হয়না। আসলে গাড়িতে যতক্ষণ যাত্রী থাকে ততক্ষণ ইউটিউব চলে না। কিন্তু সমস্যা হলো, যে অফিসারের গাড়ি পাপান চালায়, তিনি বেশিরভাগ সময়ই এয়ার ট্র্যাভেল করেন। শহরতলীর অফিস থেকে উনাকে এয়ারপোর্ট অবধি ড্রপ করে ফেরার সময় নিজের এন্টারটেনমেন্টের জন্য ইউটিউবই ভরসা।
তবে যদি সাইক্রিয়াটিস্ট দেখাতেই হয় তবে সবার কাছ থেকে লুকিয়েই দেখাতে হবে, ও নিজে এই ব্যাপারে প্রগ্রেসিভ হলেও ওর আশেপাশের লোক নিশ্চয়ই হবে না। পাপানকে পাগল ভাবতে পারে। আরো খারাপ হতে পারে। ওর চাকরিটাও চলে যেতে পারে, হাজার হোক রাজ্য সরকারের উচ্চপর্যায়ের আধিকারিককে তো মানসিক রুগীর গাড়িতে ছেড়ে দেওয়া যায় না।
সিগারেট শেষ করে গাড়িতে উঠলো পাপান। না, এটার নিষ্পত্তি না হওয়া অবধি ও আর ইউটিউব শুনবে না।
রাস্তাটা বেশ ভালোভাবেই শেষ করে এয়ারপোর্ট পৌঁছালো পাপান। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না, কুড়ি মিনিটের মধ্যেই বেরিয়ে এলো ডক্টর সৌমেন গুহ। ডক্টর গুহ নদীয়া জেলার ডিস্ট্রিক্ট মেডিকেল অফিসার। শিলং থেকে একটা মেডিকেল সেমিনার শেষ করে ফিরছেন।
পাপান গাড়ি শুরু করলো। বেশ নির্বিঘ্নেই এয়ারপোর্ট থেকে কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়েতে পৌঁছাল ওদের গাড়িটা। পিছনে বসে মোবাইল স্ক্রল করছে ডক্টর গুহ। কে একটা লিংক পাঠিয়েছে ম্যাসেঞ্জারে। লিংকটা ওপেন করলেন, ইউটিউব খুলে গেল, একটা সুন্দর গান, অহমিয়া ভাষায় লোকসঙ্গীত। গানটার মাঝপথেই শুরু হয়ে গেল বিজ্ঞাপন।
"ধুর", বলেও বিজ্ঞাপনটা শুনলেন ডক্টর গুহ। বেশিক্ষণের না, মাত্র পাঁচ সেকেন্ডের, তারপরেই আবার গানটা শুরু হয়ে গেলো।
আচমকা গাড়িটাই দাঁড়িয়ে গেলো। ডক্টর গুহ অবাক হয়ে দেখলেন, ড্রাইভার পাপান মাথা টিপে বসে আছে।
"কিছু হলো নাকি ভাই?" উদ্বেগ নিয়ে প্রশ্ন করলেন ডাক্তার।
পাপান কিছু বললো না। বিজ্ঞাপনের সুরটা আবার ওকে নিয়ে যাচ্ছে সেই পাগল করে দেওয়া অবস্থায়, যদিও ডাক্তার গুহ এর বিন্দুমাত্র কিছু জানে না।
ডাক্তার গুহ আবার প্রশ্ন করলো, “এনিথিং রং ডিয়ার?”
"স্যার, মাথাটা হটাৎ যন্ত্রণা করে উঠলো। গাড়ির সামনে মনে হলো কিছু একটা পড়েছে, চাপা দিয়ে দিয়েছি মনে হয়।" পাপান অতিকষ্টে বললো।
"বলো কি?” ডাক্তার গুহর মুখ থেকে অবাক ভাবটা যাচ্ছেই না, হটাৎ করে কি হল ছেলেটার? কাউকে চাপ দিতে তো দেখেননি উনি, এবার পাপানের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “না ভাই, সামনে কিছুই ছিল না। তুমি কাউকেই চাপা দাওনি। আচ্ছা সকালে কি খেয়েছিলে? গ্যাস হয়নি তো?"
পাপানের মাথা ব্যাথা সারেনি, তাও কষ্ট করে বললো, "না স্যার, ঠিক মতনই খেয়েছি। স্যার, একবার নেমে দেখবেন কাউকে চাপা দিয়ে দিইনি তো? আমার না খুব ভয় লাগছে।"
ডাক্তার গুহ’র মনে হলো, পাপান হ্যালুসিনেট করছে, তাও ওকে আশ্বস্ত করার জন্য বললো, "ধুর পাগল, চাপা দিলে কি বুঝতে পারতে না? ঠিক আছে দাঁড়াও আমি দেখছি," বলে ডাক্তার গুহ নেমে গেলেন গাড়ি থেকে।
গাড়ির সামনে এসে দেখলেন কিছুই চাপা পড়ে নেই। নিচু হয়েও দেখলেন। না অল ওকে। তবে গাড়িটার নিচের দিকটাতে লাল রঙের কিছু লেগে আছে। ডক্টর গুহ’র মনে হলো রক্ত, ডাক্তার মানুষ, জীবনে অনেক রক্ত দেখেছেন। হাত দিতে ইচ্ছে করলো না। সব ঠিক আছে মনে করে উঠে দাঁড়ালেন।
পাপানকে থাম্বস আপ করে বলতে যাবেন হটাৎ করেই গাড়িটা এগিয়ে এলো ডক্টর গুহর দিকে। ড্রাইভার পাপান এক্সিলেটরে চাপ দিয়ে দিয়েছে। পিষে বেরিয়ে গেলো নদীয়ার ডিস্ট্রিক মেডিকেল অফিসারকে।
বেশ কিছুদিন ধরেই সম্মোহন বা হিপনোসিসের মতন সিউডো মেডিক্যাল প্র্যাকটিসের লড়াই চালাচ্ছিলেন ডক্টর গুহ। নিজেই যে এর শিকার হবেন সেটা স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি ডাক্তারবাবু। একটা শব্দ শুনিয়ে কাউকে সম্মোহন করে, একটা আঙ্গুলের ঈশারাতেই যে একটা জঘন্য হত্যাকান্ড ঘটানো যায়, সেটা বিশ্বাস করতেই চাননি ডাক্তার গুহ কখনো। তাই উনাকে বিশ্বাস করানোর জন্যই কাজটা করতে এক প্রকার বাধ্য হয়েছিল, উনার সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ডক্টর জ্যোতির্ময় ঘোষ। তবে ডক্টর ঘোষের একটা আফসোস থেকেই যাবে, ডক্টর গুহ’র স্বীকারোক্তিটা পাওয়া যাবে না।
পরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত। পাপানকে খুঁজে পেতে কোনো সমস্যা হয়নি কারোর। ডক্টর গুহকে গাড়ি চাপা দিয়ে মেরে পাশের খালেই গাড়ি শুদ্ধ ঢুকে গেছিল। পুলিশ যখন উদ্ধার করে তখন পাপান এই দুনিয়ায় আর নেই। আশ্চর্যজনকভাবে দুজনের মোবাইলই পুলিশ খুঁজে পায়নি, জলে ঝাঁপ মারার আগে ওগুলো বন্ধ করে আগেই ফেলে দিয়েছিল পাপান।