"আপনি ভূত তাই না?" পার্থ নর্মাল গলায় প্রশ্ন করলো পাশে বসে থাকা সুন্দরী মেয়েটাকে।
খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো সুন্দরী মেয়েটা। হাসলে যেন আরো মোহময় লাগছিলো তাকে। পার্থ ভাবলো, অবশেষে তার দেখা হয়েই গেল।
"কেন? মানুষ হলে কি ক্ষতি হবে?" মেয়েটা পাল্টা প্রশ্ন করলো।
"ক্ষতি বলে ক্ষতি। প্রচন্ড ক্ষতি হবে ম্যাডাম।" উত্তেজিত কণ্ঠে বললো পার্থ।
"কিসের ক্ষতি শুনি?" ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করলো সুন্দরী মেয়েটা।
ঠিক যেন এই প্রশ্নটার জন্যই বসে ছিল পার্থ। মনের কোণে থাকা বহুদিনের এক বাসনা যেন আজ পূর্ণতা পেতে যাচ্ছে। পার্থর জীবন গড়পড়তা মানুষদের মতন না। ঠিক দ্বৈত জীবন না বললেও দিনের পার্থ আর রাতের পার্থ পুরোপুরি আলাদা। নিয়ম করে প্রতি শনিবার সে রাত আটটার সময়ে নিজের ফোর্ড গাড়িটা করে ডানকুনি হয়ে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরে বর্ধমান যায় ও আবার ফিরে আসে।
মাঝপথে রাস্তায় দেহপজিবিনিদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। এরা সব ভদ্রঘরের মেয়ে, কেউ অভাবে কেউ স্বভাবে দাঁড়ায়। কিভাবে চিনতে হবে সেটা জানা না জানলে কেউ চিনতে পারবে না তাদেরকে।
পার্থ চেনে, ওর অভিজ্ঞতা এই ব্যাপারে প্রচুর। হয়তো দেখা গেল রাস্তার পাশে কোনো গাড়ি দাঁড়িয়ে শুধু বাম দিকের ইন্ডিকেটর জ্বালিয়ে রেখেছে, কেউ বা আবার দুটো লাল রুমাল বার করে রেখেছে। পার্থ আস্তে করে ওর গাড়িটা তাদের সামনে দাঁড় করায়। নেমে জল চাওয়ার অছিলায় অন্য গাড়িটার সামনে গিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়ার পরই নিজেকে জাহির করে। দাম-দর ফাইনাল করে মেয়েটাকে নিজের গাড়িতে তোলে।
বর্ধমানের আগে ওর এক পরিচিত ধাবা আছে। এমনি সেখানে লরি ড্রাইভারদের আস্তানা, কিন্তু পার্থ পয়সা খরচ করে নিজের জন্য একটা ঘর বাগিয়েছে, তাতে এসি ও লাগানো আছে। ঘরটা বাইরে থেকে বোঝা যায় না, ধাবার পিছন দিকটা বেশ জঙ্গল, ওখানেই ঘরটা বানানো, ওটাতেই ওঠে ও। রাত যখন শেষ হয়ে ভোর হয়ে আসে, পার্থ মেয়েটাকে ছেড়ে দেয় কোনো বাস-স্ট্যান্ডের কাছে। মেয়েটা বাসে উঠছে দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে তারপর বাড়ি ফিরে আসে।
আজ অবধি ওর এই রাতের জীবনের কথা ও কাউকে বলেনি। কিন্তু আজ ঠিক করলো ওর গাড়ির প্যাসেঞ্জার সিটে বসা এই সুন্দরীকে বলবেই।
"আসলে আমি কিন্তু ওই যাকে বলে ভদ্র সন্তান তা ঠিক নই।” পার্থ বললো, “মানে আবার ঠিক অভদ্রও নই। আসলে আমি যে কি সেটকে বাংলায় কি বলে জানি না।” এইটুকু বলে মেয়েটার মুখের দিকে তাকালো ও, একদৃষ্টে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে মেয়েটা। পার্থ বুঝতে পারলো মেয়েটা ওর গল্পটা শুনতেই চাইছে।
আবার শুরু করল পার্থ, “প্রতি সপ্তাহেই এ রাস্তায় আমি গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ি রাতের দিকে, নারীমাংসের খোঁজে।”
“নারীমাংস মানে বেশ্যা?” মেয়েটা প্রশ্ন করল, পার্থ দেখলো এবার আর ওর দিকে তাকিয়ে নেই মেয়েটা, জানালা দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। পার্থর একবার মনে হলো, এই গল্পটা এখানেই শেষ করে দেওয়া যাক, কিন্তু আবার কি একটা ভেবে বলা শুরু করলো।
“হ্যাঁ, ঐ আর কি! এই রাস্তাতেই পাওয়া যায়, বুঝলেন? বেশিরভাগ রাতে যাদের গাড়িতে ওঠাই তারা ওঠে তাদের রেট জানিয়ে। সামনে জ্যোতি সিংয়ের ধাবা আছে, আমি ওখানেই যাই, একটা সেফ রুম নেওয়া আছে। পয়সা দিয়ে কাজ শেষ করে মেয়েদের অবশ্য নামিয়ে দিই সেফ জায়গায়। এব্যাপারে আমি এথিক্স মেনে চলি। ভোরের দিকে আমি বাড়ি ফিরে আসি। গাড়িতে ওঠানোর সময় তাদের রূপ আর গাড়ি থেকে নামানোর সময় তাদের রূপের পরিবর্তন আমাকে সবসময় মজা দেয় জানেন?" সোজাসাপ্টা ভাবে নিজের রাতের জীবন জানিয়ে দিতে পেরে ওর একটা অদ্ভুত রিলিফ হলো।
"এই গাড়ি থামান প্লিজ।” মেয়েটা পার্থর দিকে তাকিয়ে বললো, “আপনি ওই জন্য এত রাতে গাড়ি নিয়ে বেড়িয়েছেন? আমি কিন্তু ওরকম না। আমি যা বলেছি তা কিন্তু সত্যি। আপনার যদি ওরকম কোনো উদ্দেশ্য থাকে আমাকে নামিয়ে দিন প্লিজ।" মেয়েটা বেশ ঘাবড়ে গেছে, পার্থর মনে হলো। চোখে মুখে একটু ভয়ের চাপ ফুটে উঠেছে মনে হচ্ছে।
"আরে, না না! আপনাকে যখন গাড়িতে তুলেছি আর সব শুনেই তুলেছি তখন বর্ধমান স্টেশনে আপনাকে না পৌঁছে দিয়ে আমি ছাড়ছি না। আমি শুধু সত্যিটা বললাম। আমি বহুগামী হতে পারি, ধর্ষক নই। আমি টাকার বিনিময়েই যৌনতাতে অভ্যস্ত ম্যাডাম। আপনি ভয় পাবেন না, আমার দ্বারা আপনার কোনো ক্ষতি হবে না, সেটা প্রমিস।" পার্থ ব্যস্তসমস্ত হয়ে উত্তর দিল। ওর একবার মনে হলো, মেয়েটার হাত ধরে ওকে নিশ্চয়তা দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু তাতে হিতে বিপরীত হবে মনে করে গাড়ির স্টিয়ারিং আর গিয়ারের উপরেই হাত রাখা মনস্থির করলো বেচারা।
"আমি কিন্তু আপনাকে ধর্ষক বলিনি।" মেয়েটা জিভ কেটে বললেও পুরোপুরি ভয় কেটেছে বলে মনে হলো না।
"না তা বলেননি, কিন্তু ওই যে, ব্যাপারটা আমি ক্লিয়ার করে দিলাম। জানেন প্রথমবার কাউকে বললাম আমার জীবনের এই ঘটনাটা। বিশ্বাস করুন এত সহজে বলে দেব সেটা ভাবিনি। তবে একটা জিনিস আপনার গল্পটা কিন্তু আমি বিশ্বাস করিনি। তাই আসলে আপনি কে, কোথায় যাবেন একটু খুলে বলবেন প্লিজ? আপনার নামটাও তো বলছেন না।" হাসতে হাসতে বললো পার্থ। ওর গলার আওয়াজে স্পষ্ট অবিশ্বাসের সুর।
আসলে যে ঘটনাটা হয়েছে পার্থ সেটার জন্য প্রস্তুত ছিল না। সাধারণত ডানলপ থেকে দশ কিলোমিটারের মধ্যেই ওর যা দরকার পেয়ে যায়, বর্ষাকালে বেরিয়েও দেখেছে, ব্যবসা ব্যবসার মতনই চলছে। কিন্তু আজ একি হলো! প্রায় ধনেখালী পৌঁছে গেল তাও কাউকে দেখতে পেল না। কি একটা মনে হওয়াতে সামনের পেট্রোল পাম্পে ঢুকে গেলো ও। উদ্দেশ্য ছিল পেট্রোল ভরানো ও তার সংলগ্ন কোনো হোটেল থেকে যদি কোনো ইশারা পায়।
এই ব্যাপারে ও ঠিক নিশ্চিন্ত ছিল না, কারণ আগে কখনো পেট্রোল পাম্পের আশেপাশের হোটেল গুলোতে ও যায়নি, তাও চেষ্টা করলো একবার, যদি কোনো কিছু পাওয়া যায়, ঐ অনেকটা ক্ষিদে পেটে যা খেতে পাওয়া যায় আর কি। আসলে ওই হোটেল গুলোর দুর্নামের ব্যাপারে পার্থ বেশ ওয়াকিবহাল, পলিটিক্যাল ক্রাইমগুলো মূলত এই রোড সাইড হোটেলগুলোতেই রমরমিয়ে চলে, সেটা কে না জানে?
পেট্রোল ভরে নেওয়ার পর পেমেন্ট করছে এমন সময় হঠাৎ ওর চোখ গেল আটকে গেলো এক জায়গায়। পাম্প থেকে বেরিয়ে যাওয়ার রাস্তাটার মুখে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর ওর দিকেই যেন দেখছে। মেয়েটার পরনে ভদ্রস্ত কাপড়চোপড়, একটা হালকা নীল রঙের চুড়িদার আর ডিপ নীল কামিজ পরে আছে। পিঠে আর হাতে একটা করে ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কারোর জন্য অপেক্ষা করছে মনে হয়।
গাড়িটা স্টার্ট দিয়ে এগিয়ে গেলো ও। গাড়ির প্যাসেঞ্জার সিটের কাঁচ নামিয়ে রেখেই এগিয়ে গেলো মেয়েটার দিকে। মেয়েটার ঠিক সামনে গাড়িটা দাঁড় করালো।
পার্থ বুঝতে পারলো মেয়েটা অপরূপ সুন্দরী, কিন্তু বর্তমানে বেশ উদ্বিগ্ন। মেয়েটার সাথে অল্প কথা বলে জানতে পারলো, সে বর্ধমান যাবে। উবের করে যাচ্ছিল, মাঝপথে এখানে পেট্রোল ভরাতে এসে যখন মেয়েটা টয়লেট গেছিল, ওর ড্রাইভার ওকে ফেলে পালিয়েছে।
শুনে মনে মনে খুব হেসেছিল পার্থ। এত বাজে গল্প ও কোনোদিনও শোনেনি। কিন্তু মেয়েটা সুন্দরী। প্রচন্ড সুন্দরী যাকে বলে। ভাবলো আজ যখন এখনো কাউকে পেলো না, তাহলে এই মেয়েটাকেই গাড়িতে তুলে নিলে হয়। বর্ধমান তো বেশিক্ষনের রাস্তা না।
পুণ্য অর্জন হয়ে যাবে, আর মাঝ রাস্তায় কথা বলতে বলতে যদি অন্য পুণ্য অর্জনের সুযোগ চলে আসে তাহলে তার সদ্ব্যবহারও করে নেওয়া যাবে। ও নিজে ভালো ছেলে না, মেয়েটাও যে ধোয়া তুলসীপাতা হবে না, সেই গ্যারান্টিই বা কে দিলো। হয়তো এরা অন্য গ্রূপ। এইভাবেই খদ্দের তোলে। তাই চান্স নিতে দোষ কি? এক বাক্যেই গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে পার্থ এগিয়ে চললো বর্ধমানের দিকে। গাড়িটার কাঁচ বন্ধ করে এসি চালিয়ে কথা শুরু করলো পার্থ।
"আপনাকে যা বলেছি সেগুলো একটাও মিথ্যে না মিস্টার পার্থ। আমার নামটা শুধু বলিনি, সেটা উহ্য থাক না! মেয়েদের ব্যাপারে সব জানতে নেই।" মেয়েটা অনুনয়ের সুরে বললো।
"কেন? ফেসবুক, ইন্সটা থেকে খুঁজে নেব বলে?" স্মার্ট হওয়ার চেষ্টা করলো পার্থ।
"আমি আসলে ওসবে নেই। ইমেলে পেতে পারেন। নামার সময় দিয়ে যাবো।" শান্ত স্বরে জানালো মেয়েটা।
"তাহলে বলতে চান আপনার উবের আউটস্টেশনটা আপনাকে ফেলে পালিয়েছে এটা বিশ্বাসযোগ্য? যেখানে আপনার এই কমপ্লেনের উপর ওর লাইসেন্স অবধি ক্যান্সেল হতে পারে?" এবার পার্থ একটু সিরিয়াস। মেয়েটা কোথাও একটা বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলছে, কিন্তু পার্থ ধরতে পারছে না। এইটুকু বুঝেছে মেয়েটা পুরো সত্যি বলছে না। আর সেটাই মেয়েটার উপরে পার্থর আগ্রহ আরো বাড়িয়ে তুললো।
"হুম, বুঝলাম। আপনি তাহলে সত্যিটাই শুনতে চান।" হাল্কা হেসে বললো মেয়েটা, "ঠিক আছে, তাহলে বলি আমার রেট ঘন্টায় দশ হাজার টাকা। সামনের কোনো হোটেলে চলুন। কাজ সেরে পেমেন্ট দিয়ে নামিয়ে দেবেন আবার কোনো পেট্রোল পাম্পের সামনে। কি রেট ঠিক আছে তো!"
"উহু, এটাও বিস্বাস করলাম না। সেরকম মেয়ে আমি চিনতে পারি। আমার অভিজ্ঞতাকে ছোট করবেন না।" ঘাড় নাড়িয়ে বললো পার্থ।
"তাই নাকি? শার্লক হোমস যে পুরো।"
"না শার্লক হোমস তো আমি নই ই। কারণ উনি মহিলা চিনতেন না। আমি চিনি। প্রমান চান। দাঁড়ান আপনাকে দেখাই, ড্যাশবোর্ডটা খুলুন। প্লিজ খুলুন।"
পার্থর একপ্রকার আদেশে মেয়েটা ওর সামনে থাকা ড্যাশবোর্ডটা খুলে ফেললো। একটা ডায়েরি ও একটা ফোল্ডার পেল সেখানে।
"দেখুন ওখানে একটা ডায়েরি আছে। হ্যাঁ ওটাই। বার করুন।"
মেয়েটা ডায়েরিটা বার করলো। লাল মলাট দেওয়া ডায়েরি।
"উল্টে দেখুন। প্লিজ।" পার্থ আর্জি জানালো।
সাধারণ ডায়েরি না সেটা। রীতিমত পার্থর সমাজসেবার হিসেব। প্রতি রাতের জন্য এক পাতা বরাদ্দ। কখন তুলেছে, কথা থেকে তুলেছে, কোথায় নামিয়েছে, পারফরম্যান্স কিরকম, ব্যবসার কারণে নাম, আর যদি কোনো কারণে আসল নাম জানা থাকে তাহলে সেটাও লেখা থাকে ওই ডায়েরির পাতায়।
"ওরে বাবা, এত রীতিমত বায়োডাটা কালেকশন। এতে করে কি সব মেয়ের ডিটেলস রেখেছেন। উরি বাবা, একশো ছাপান্ন? আমি কি তাহলে একশো সাতান্ন?"
"ঠিক মতন দেখলেন না। অনেকের সাথেই একাধিকবার হয়েছে। আসলে আমি খুব বেশি রাস্তা চেঞ্জ করি না। শেষ তিন বছর ধরে এটাই আমার রুটিন, বিনোদনের একমাত্র ধরণ।
আমি প্রেম করতাম মেঘনার সাথে। তিন বছর আগে মেঘনার বিয়ে হয়ে গেল। জানেন আমার মাইনে এখন দেড় লাখ, সপ্তাহে শনি রবি ছুটি, আলিপুরে ফ্ল্যাট, নিজের গাড়ি সব আছে। তিন বছর আগে শুধু এগুলো ছিল না। কিন্তু মেঘনা ছিল, দীর্ঘ সাত বছর ধরে ছিল। ওর যাওয়ার পরই সব হলো। ঠিক পরের দিনই চাকরিটা এলো। তার একমাস পর থেকে শুরু হলো আমার এই নৈশ অভিসার। সাধারণত শনিবারই বেরোই। মাঝে মাঝে শুক্রবারও হয়ে যায়। বোঝেনই তো। শরীরের দাবি। তাই ডায়েরি মেইন্টেন করি।”
একটু থামল পার্থ, আবার বলা শুরু করল, “কোনো অসৎ উদ্দেশ্যে ওটা লিখিনা। তাই তো ছবি পাবেন না। ফোন নাম্বার ও পাবেন না। একশো সাতান্নটা মেয়ের সাথে শুয়েছি, কিন্তু দুশো বার তো এটলিস্ট হয়েই গেছে। এই যে আমি যে রুমে যাই, সেখানে কিন্তু কোনো রেকর্ডিং ডিভাইস রাখিনী।
কি আর করবো বলুন তো। টাকা খরচ করার তো একটা জায়গা চাই নাকি। আমার আবার ট্রাভেলে বিরক্তি আসে, সেই এক সমুদ্র না হয় পাহাড়। ধুর, ওগুলো আমাকে তৃপ্তি দেয় না।
তাই মানব সভ্যতার সবথেকে পুরোনো পেশাই আমার কাছে সবথেকে প্রিয়। এবার নিশ্চই বুঝতে পারছেন আপনাকে আমি ঐ দলে ফেলতে পারছি না, তাই তো আপনার সত্যিটা আমার জানা জরুরি।" কথা শেষ করে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকলো তিন সেকেন্ড মতন।
"দেখুন আমি আগেও যা বলেছি এখনো তাই বলছি। আমি যেখানে থাকি সেটা কোনা এক্সপ্রেসের পাশেই। আমার ট্রেনের টিকিট বর্ধমান থেকে, উবের ধরে বর্ধমান আসছিলাম। ডানকুনি পেরোনোর পর ড্রাইভার বললো ও পেট্রোল ভরাবে, আমি টয়লেট গেছিলাম, এসে দেখি নেই। ফোন সুইচ অফ ড্রাইভারের। কি করবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। উবের, ওলা কোনোটাই পাচ্ছি না। এত রাতে একা কি করবো অচেনা যায়গা। ভয় হচ্ছিল। আপনাকে দেখলাম, দেখে ভদ্রলোক লাগলো। তাই উঠে পড়েছি আপনার গাড়িতে। এবার দেখুন আপনার ব্যাপার। পেট্রোল পাম্প তো রাতে লরি ড্রাইভারদের একচেটিয়া হয়ে যায়। আপনি তাদের থেকে তো সেফ।"
"বুঝলাম, কিন্তু তা যদি হয় আপনার ব্যাগ বলতে কি শুধু ওই পিঠব্যাগটা? ওটা নিয়ে টয়লেট গেছিলেন?"
"হ্যাঁ, ওটা সাথেই থাকে। দেখুন আমার পিরিয়ড চলছে। প্যাড চেঞ্জ করার ছিল। নইলে আমি পেট্রোল পাম্পের টয়লেটে যাওয়ার মেয়ে না।" দৃশ্যত অস্বস্তিতে পড়ে গেছে মেয়েটা।
পার্থ হাসলো, "তাহলেই বলুন আপনি কিভাবে প্রস্টিটিউট হবেন? পিরিয়ড চলাকালীন কেউ এইসব কাজ করে না। আর তাছাড়া এই গল্পটাতেও বিস্তর গোলমাল!!সত্যিটা বলুন না প্লিজ!"
"এটাতেও আবার কি গোলমাল পেলেন?"
"এক, আপনার বাড়ি কোনা এক্সপ্রেসের কাছে হলে সাঁতরাগাছি থেকে ট্রেন ধরে হাওড়া যাওয়া অনেক সোজা ছিল, পয়সা খরচ করে উবের করে বর্ধমান, এটা ঠিক বোধগম্য হলো না।
দুই, বাড়ি থেকেই বেড়িয়েছেন যখন তখন তো নতুন প্যাড লাগিয়েই বেড়িয়েছেন, মানে সবাই নিশ্চয়ই তাই করে, এইটুকু আসতে সেটা চেঞ্জ ও করতে হলো? তিন, আমার আগেই একটা ফ্যামিলি কার ছিল পেট্রোল নিলো, তাদের ও বলতে পারতেন। চার, পুলিশে ফোন করতে পারতেন। অতএব আপনার গল্প, ওই যাকে বলে, মানছি না মানব না।"
"ওরে বাবা, আবার শার্লক হোমস!” মেয়েটা হেসে ফেললো, পার্থ তাকিয়ে দেখলো হাসলে মেয়েটাকে আরো বেশি সুন্দরী লাগে। “তাহলে আরো ভিতরে ঢুকে বলি শুনুন, তাতে আপনার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন। এক, আমি হাওড়া থেকে রিজার্ভেশন পাইনি। বর্ধমান থেকে পেয়েছি। সাঁতরাগাছি থেকে হাওড়া যাওয়ার আপনার হয়তো অভিজ্ঞতা নেই, আমার আছে। তাতে ট্রেন মিস করার সম্ভাবনাই বেশি। দুই, আমি পেশায় শিক্ষিকা। একটা ব্যাচ পড়ানোর ছিল, পড়িয়েই বেরিয়ে গেছি। চেঞ্জের সময় পাইনি। ভেবেছিলাম স্টেশনের ওয়েটিং রুমের টয়লেটে চেঞ্জ করবো, গাড়িটা দাঁড়ালো বলে, আর ওখানে একটা রেস্তোরাঁ ছিল বলে ওই টয়লেটটাতেই গেলাম। তিন, ফ্যামিলি কার বর্ধমান যাচ্ছে না জানিয়েছিল। চার, আপনাকে না পেলে পুলিশকেই বলতাম। হয়েছে?"
"গল্পটা ভালোই ফেঁদেছেন।" পার্থ একটা হাসি দিয়ে বললো।
"আপনি এবার না মানলে আপনার ব্যাপার। আচ্ছা ওই প্রশ্নটা কেন করলেন?"
"কোনটা?"
"ওই যে আমি ভূত নাকি?" একটু ইচ্ছে করেই যেন নাকি সুরে প্রশ্নটা করলো মেয়েটা।
"ও আচ্ছা।” পার্থ একগাল হাসি দিয়ে বললো, “আরে, আমার না খুব শখ ভূত দেখার। রাতে এত গাড়ি চালিয়েছি আজ অবধি দেখতে পাইনি জানেন। প্রত্যেকবার কোনো না কোনো মেয়েকে যখন গাড়িতে তুলি তখনই ভাবি এ ভূত হলে কেমন হবে? কিন্তু দুর্ভাগ্য। আজ অবধি একটাও পেলাম না। অনেকেই যদিও মানসিকভাবে মরে গিয়ে এই পেশায় আসে, তবে ভূত মানে মৃত মানুষ ভয় দেখাতে আসছে এই অভিজ্ঞতা জাস্ট শুন্য। অবশ্য আপনি হতেই পারেন। আমি তো এখনো জানি না আপনি ইহলোকের না পরলোকের?"
"ও এই ব্যাপার। তাহলে তো বলতেই হয় আপনার প্রশ্ন ভুল।"
"কেন ভুল?"
"মেয়েরা ভূত হবে কি করে? ভূত তো পুংলিঙ্গ। ব্যাকরণ মানলে আমি হবো পেত্নী।"
দুজনেই হো হো করে হেসে উঠল।
তারপর পার্থ বললো, "আচ্ছা, একটা প্রশ্ন আছে এই ব্যাপারে, আপনি পেত্নী কেন হবেন? মানে শাকচুন্নিও তো হতে পারেন। মেয়েরা তো ঐ দুটোর মধ্যে একটা হয়।"
"আজ্ঞে না স্যার, আপনার ভূতের ব্যাপারে সাধারণ জ্ঞান তো দেখছি নেই বললেই চলে। অবিবাহিত মেয়েরা পেত্নী হয়, বিবাহিতরা শাকচুন্নি। শুধু মেয়েদের বিছানায় তুললেই হবে? তাদের ব্যাপারে জানতেও তো হবে নাকি।"
"ও আচ্ছা আপনি অবিবাহিত। তাহলে একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করবো?"
"আমি ভার্জিন কিনা? সেক্স করেছি কিনা?" পার্থর মনে হলো, মেয়েটা ওর সাথে কথা বলতে বলতে বেশ পছন্দই করছে।
"আরেব্বাস আমার মনের কথা কিভাবে জানলেন? শিওর আপনি ভূত, এই না ভুল বললাম, পেত্নী হবে তাই তো।"
"আপনার মনের অবস্থা জানতে গেলে অন্তর্যামি হওয়ার দরকার পড়ে না। আপনি যেভাবে সেক্সের প্রতি একনিষ্ঠ, তাতে করে ওই প্রশ্নটা এখনো কেন করেননি সেটাই ভাবছিলাম। উত্তর ও দিয়ে দিই, আমি ভার্জিন নই, সেক্সের অভিজ্ঞতাও অনেকবার আছে। আর হ্যাঁ, আপনি যেভাবে আমাকে শুরু থেকে চোখ দিয়ে মেপে চলেছেন তাতে করে আমার জামাকাপড় ও আপনি অনায়াসেই কিনে নিতে পারবেন, কি ঠিক বললাম কিনা? আচ্ছা সব মেয়েকেই কি এভাবে দেখেন?"
"নাহ না, সবাইকে দেখার দরকার হয় না। সত্যি বলতে আপনার মতন মেয়ের দেখা আমি জীবনে এই প্রথমবার পেলাম। মেঘনা দারুন সুন্দরী ছিল, কিন্তু আপনি ওই যাকে বলে সত্যিকারের সেক্সী। বিউটি উইথ ব্রেন। এই আপনার বয়ফ্রেন্ড আছে? না থাকলে আমার চান্স হবে?" পার্থ চোখ টিপে প্রশ্ন করলো।
"না, আমার কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই। আর আপনার চান্স? একশো ছাপান্ন জন যাকে সুখ দিতে পারেনি, আমি সেখানে তো এক। না বাবা, দরকার নেই আমার আপনার মতন বয়ফ্রেন্ড।"
"এই চা খাবেন? শক্তিগড় ঢুকে গেছি!" হটাৎ করেই প্রসঙ্গ বদলালো পার্থ। অন্ধকার ন্যাশনাল হাইওয়েতে হটাৎ করেই প্রচুর আলো এসে পড়েছে যেন।
"এত রাতে? বাহ অনেক দোকান খোলা আছে দেখছি তো! কিন্তু না, চা খাবো না। আমার ট্রেন মিস হয়ে যাবে তো!" কাটিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই বললো সুন্দরী মেয়েটা।
"কটার ট্রেন সেটা তো বলেননি। নইলে বলবো কি করে ট্রেন মিস করার চান্স কতটা।"
"আমার ট্রেন সাড়ে এগারোটাতে, বর্ধমান স্টেশন থেকে।"
"ওহ! এখন সবে তো ন’টা বাজে। এখান থেকে বর্ধমান স্টেশন ত্রিশ মিনিট ও লাগবে না।"
"আচ্ছা চলুন, ভালো দোকানে দাঁড় করাবেন প্লিজ। আমি টয়লেট যাবো।" মেয়েটা অবদারের সুরে বললো।
"আবার চেঞ্জ করতে হবে?" পার্থ চোখ টিপে বললো।
"সারাক্ষন শুধু ঐদিকেই মন তাই না? আচ্ছা আপনার ওই জ্যোতি সিং এর ধাবা পেরিয়ে গেছেন?"
"সে তো অনেকক্ষন! কেন যেতেন নাকি?" পার্থ কিছুটা উৎসুক হয়ে বললো।
"বাদ দিন, চলুন চা খাই। আর হ্যাঁ, আমি খাওয়াবো। আপনার এটলিস্ট একটা সাম্মানিক প্রাপ্য।"
"সাম্মানিক এ চা!! বাহ!! সাম্মানিক হিসাবে সারা জীবনের জন্য বন্ধুত্ব চাইতে পারি?"
"পারেন, কিন্তু আমি তা দিতে অপারগ। তাই চা টাই চলুক আপাতত।"
"যে আজ্ঞা।" পার্থ একটা দোকানের সামনে গাড়ি দাঁড় করালো। দুজনে নেমে দোকানে ঢুকলো।
মিনিট কুড়ি লাগলো দোকান থেকে চা খেয়ে আবার গাড়িতে উঠতে।
ন্যাশনাল হাইওয়েতে গাড়িটা উঠলে মেয়েটা পার্থর দিকে তাকিয়ে বললো, "আপনি কি খুব ভূতের গল্পো ভালোবাসেন?"
"ফেভারিট, বলতে পারেন। সানডে সাসপেন্সের সব শোনা, আরো দুতিনটে ভালো ভালো চ্যানেল আছে ইউটিউবে, ওগুলো ও শুনি। আপনি শোনেন না?"
"শুনি তবে, তার সাথে আমি গল্প ও লিখি। তবে ভূতের না, ওই সোশ্যাল কজ, প্রেমের গল্প এইসব আর কি।"
"এটা কি ধরণের কেস হোলো? এতক্ষন ধরে একটা গল্প তো শোনাতে পারতেন।" পার্থ কপট রাগ দেখালো।
মেয়েটা পাত্তা দিলো না, উল্টে বললো, "পারতাম, কিন্তু আপনি তো যৌনতাতে আটকে ছিলেন।"
"ধুর ধুর ওসব সেকেন্ডারি। লেখিকার মুখ থেকে তার লেখা গল্প শোনার আনন্দই আলাদা। আচ্ছা আপনার প্রেমের গল্পে যৌনতা আসে না? বলুন না সেরকম একটা গল্পো।"
"এবাবা, গল্প লিখি আমি, বলতে তো পারিনা। আসলে, গল্প বলতে গেলেই আমার প্যালপিটিশন হয়, স্টেজ ফিয়ার আছে আমার।"
"ধুর, ঐসব কিছু না। আরে, যারা লেখে তারা তো তাদের মতন গল্পটা মনে মনে ভেবেই লিখছে। অতঃপর শোনান দেখি একটা। এটাকেই সাম্মানিক ভেবে নেব।"
মেয়েটা একটু ভেবে নিলো, তারপর বললো "একটা গল্পো লিখেছিলাম তিন দিন আগে, শুনবেন?"
"ইরশাদ!"
"ঘড়িতে তখন রাত সাড়ে আটটা। একটা পেট্রোল পাম্পে একাকী একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাইরোডের পাশেই পেট্রোল পাম্প। ব্যস্তসমস্ত হয়ে যে ভদ্রলোক পেট্রোল দিচ্ছিলেন তাকেই জিজ্ঞেস করছে, 'দাদা, সত্যি বলুন তো ট্যাক্সিটা চলে গেছে?' মেয়েটার গলায় স্পষ্ট ভয়ের আভাষ। সুন্দর চোখ দুটো যেন ভিজে আসছে।
'দিদি দেখুন, সাদা রঙের একটাই সুইফট ডিজায়ার এসেছিল, চলে গেছে। আপনাকে নামতে আমি দেখেছিলাম কিন্তু ভেবেছিলাম আপনি নামার জন্যই এসেছেন।' ভদ্রলোক বললেন।
'নামার জন্য এসেছি মানে?' মেয়েটা চেঁচিয়ে উঠলো, 'রাত সাড়ে আটটাতে একটা মেয়ে পেট্রোল পাম্পে ট্যাক্সি ধরে এসে কি করবে বলুন?'
লোকটা মুচকি হেসে পাশে থাকা রেস্তোরাঁ কাম লজটাকে দেখিয়ে বললো, 'পারলে এখানে দাঁড়িয়ে থাকুন, অনেক মেয়েই রাতে ওখানে আসে। ওদের ছেঁড়ে যাওয়া গাড়িতে করে চলে যাবেন।'
মেয়েটা একা দাঁড়িয়ে থাকলো। আধঘণ্টাতেও কারোর দেখা মিললো না, পাম্পে গাড়ি আসার সংখ্যাও কমতে লাগলো। ভয়টা বাড়ছে এবার। কি কুক্ষনেই যে টয়লেট করতে গেছিল ও ওই রেস্তোরাঁতে। একবার ভাবলো পুলিশকে ফোন করি। কিন্তু তাহলেই তো ধরে নিয়ে গিয়ে বাড়িতে দিয়ে দেবে।
কি যে ঝামেলায় পরলো, যার কথায় পালিয়েছে তার ফোন ও নট রিচেবেল। রেস্তোরাঁয় কি হয় সেটা শোনার পর থেকে ওখানে যাওয়াটাও সেফ লাগছে না, শেষে কিনা যদি পুলিশের রেইড হয়। অনেক ভেবেচিন্তে আবার ফোন করলো জয়ন্তকে। জয়ন্ত জয়শ্রীর বয়ফ্রেন্ড। ওরা পালিয়ে বিয়ে করবে ঠিক করেছে পরশুদিন। আজ ওরা পালাচ্ছিলো। জয়শ্রী একটা উবের ধরে বর্ধমান যাবে, আর জয়ন্ত নিজের বন্ধুর বাইকে করে বর্ধমান যাবে। তারপর ট্রেনে করে পাটনা। ওখানেই জয়ন্তর এক বন্ধুর বাড়িতে বিয়ে হবে। তাই বাড়ি থেকে বেরোনোর পরই সিম খুলে ফেলে দিয়েছিল, নতুন সিম আগে থেকেই কিনে রেখেছিল যার নাম্বার জয়ন্তর কাছে ছাড়া কারোর কাছে নেই। ও নিজে কন্টাক্ট না করলে বাড়ির লোক যে কন্টাক্ট করবে তার ও কোনো রাস্তা নেই।
পাম্পটা প্রায় শুনশান। আধ ঘন্টা পর একটা গাড়ি এলো। গাড়িতে মনে হলো দুই ভাই বসে আছে। একজন চালাচ্ছে আর একজন পাশের সিটে বসা। জয়শ্রী সব খুলে বললো। ওরা লিফট দিতে রাজি হলো, তারপর একটা নির্জন রাস্তার পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে, দুই ভাই মিলে গাড়ির পিছনের দিকে উঠে জয়শ্রীকে জাপটে ধরলো। বড় ভাই যখন মুখ আর হাত ধরে রেখেছিল জয়শ্রীর খুব কষ্ট হচ্ছিল, বড় ভাইয়ের হয়ে গেলে ছোট ভাই এলো বড়র জায়গায়। জয়শ্রী প্রথম পাঁচ মিনিট ওদের আটকানোর চেষ্টা করেছিল, তারপর আর করেনি।
কাজ হয়ে গেলে ওকে ওখানেই ফেলে রেখে ওরা গাড়ি স্টার্ট দেয়। অতি কষ্টে উঠে দাঁড়ায় সে। রাস্তায় আসা গাড়িকে হাত দেখায়। কেউ দাঁড়ায় না, অবশেষে একটা দাঁড়ায়।" মেয়েটা একটু থামলো, যেন সাসপেন্স তৈরি করার চেষ্টা করছে।
"আর তাতে ছিল জয়শ্রীর বয়ফ্রেন্ডের দল।” মেয়েটাকে বলতে না দিয়ে পার্থ বলে উঠল, “জয়শ্রীকে বিয়ের লোভ দেখিয়ে পাচার করার তালেই ছিল ওরা, তাই ও আসছে না দেখে ওরা খুঁজতে বেরোয়, রাস্তায় যখন পায়, হয় তুলে নিয়ে গিয়ে পাচার করে, নয় আবার রেপ করে ফেলে দেয়, একটা গাড়ির তলায় জয়শ্রী আত্মহত্যা করে, কি তাই তো?"
"আশ্চর্য্য, এটাই তো আমার গল্পের শেষ ছিল, আপনি জানলেন কি করে?" মেয়েটা যেন অবাক হলো।
"শুনুন ম্যাডাম, এই গল্প অতীতে বহুলোক লিখেছে, বর্তমানে বহুলোক লিখছে আর ভবিষ্যতেও বহুলোক লিখবে, ঐ অনেকটা মহাভারতের মতন, বুঝলেন তো। আপনার গল্পের ক্লাইম্যাক্স যাই হোক সেটা মৌলিক গল্পের মধ্যে পরে না। ভেরি সরি টু সে।" পার্থর গলার আওয়াজে বিরক্তি স্পষ্ট। প্রচুর সাসপেন্সের গল্প শোনা পার্থ এত দুর্বল একটা গল্প আশা করেনি।
"আর এটা যদি সত্যি হয়ে থাকে তো?" মেয়েটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো।
"মিথ্যে ঘটনা তো বলিনি দিদিমণি। শুধু গল্পো হিসেবে খুব ক্লিশে। নিন, বর্ধমান এসে গেছে। আপনার সাথে আমার সময়টা ভালোই কাটলো।" গাড়ির গতি কমিয়ে এনেছে পার্থ।
"এই নিন আমার ইমেল।" একটা কাগজে মেয়েটা কি একটা লিখে পার্থর হাতে দিলো। পার্থ ভাঁজ করে ড্যাশবোর্ডের মধ্যেই রেখে দিল।
"হুম!" হাত নেড়ে সংক্ষেপে বিদায় জানালো পার্থ।
"বাই!"
"ভালো থাকবেন।"
বর্ধমান স্টেশনে গাড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে পার্থ দেখলো মেয়েটা ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। স্টেশন ছেড়ে বাঁ দিকে বাঁক নেওয়ার সময় আর দেখতে পেল না মেয়েটাকে।
এবার ফেরার পালা। এত বছরে প্রথম ব্যর্থ পার্থ আজ। যদিও একটা মেয়েকে নিরাপদে এত রাতে স্টেশনে পৌঁছে দিতে পেরেছে বলে নিজের উপর রীতিমত গর্ব অনুভব করলো ও। বর্ধমান স্টেশন থেকে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে উঠতে সময় লাগলো সাত মিনিট। আজ আর নারীসঙ্গে ওর মন নেই। রাস্তার পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে টয়লেট করবে ভেবে গাড়িটা দাঁড় করাতে যাবে এমন সময় ফোনটা বেজে উঠলো।
"হ্যালো!"
"মিস্টার মুখার্জি! আমি পামেলা বলছি।" ওপার থেকে একটা মধুর আওয়াজ কানে এলো।
"কোন পামেলা?"
"আরে যাকে এইমাত্র বর্ধমান ছেড়ে দিলেন।"
"ও আচ্ছা, আপনার নামটাই তো জানা হয়নি। আর তাছাড়া আমার নাম্বারটা আপনি কোথায় পেলেন?"
"আপনার ডায়েরির মধ্যে ফার্স্ট পেজেই ছিল, আমি মনে রেখে দিয়েছিলাম।"
"বাবা, দারুন মেমোরি তো আপনার। বলুন কি হলো!"
"এই একটা জিনিস না আপনার গাড়িতে ফেলে এসেছি। ওটা একটু কাইন্ডলি পুড়িয়ে ফেলবেন? তাহলে খুব ভালো হয় আর কি?"
"পুড়িয়ে ফেলবো? সেটা কি?"
"আমার লাশটা। পিছনের সিটে দেখুন রাখা আছে।"
"কি যাতা রসিকতা করছেন?"
"আরে রসিকতা না। সত্যি, একবার পিছন ঘুরে দেখুনই না। শুনুন আমিই সেই গল্পের জয়শ্রী। ওটা আমারই লাশ। পরশু রাতে ওরকম হওয়ার পর পুলিশ ওটা ওই পেট্রোল পাম্পের পাশে ফেলে দিয়ে গেছিল। কাল রাতে ওই দুই ভাইকে আবার পেয়েছিলাম, ওদের ডিভাইডারে ধাক্কা দিয়ে মেরেছি। আমার হবু বরকেও সেম ভাবে শেষ করেছি। আমি ভেবেছিলাম আপনাকেও মেরে ফেলবো, কিন্তু আপনাকে খুব ভালো লেগে গেল। তাই চলে যাচ্ছি, প্লিজ আমার বডিটাকে পুড়িয়ে অস্থি বিসর্জন দিয়ে দেবেন। নইলে প্রতি রাতে আমাকে আসতে হবে।"
ক্যাচ করে ব্রেক কষলো পার্থ। ঘেমে উঠেছে ও। দরজা খুলে বেরিয়ে এসে পিছনের ডানদিকের দরজা খুলতেই দেখতে পেল কালো প্লাস্টিকে ঢাকা একটা লম্বা মতন বস্তু। এটা কখন গাড়ির সিটে এলো? ভয়ে ভয়ে হাত দিল বস্তাটার গায়ে। গাড়িতে থাকা এসির থেকেও ঠান্ডা। দরজা বন্ধ করে পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকলো মূর্তির মতন। পাঁচ মিনিট পরে পেটটা মোচড় দিয়ে উঠলো। রাস্তার পাশেই হাল্কা হলো পার্থ। তিনটে সিগারেট পরপর শেষ করলো। তারপর পিছনের বাম দিকের দরজা খুলে রাস্তার পাশে নামিয়ে দিল বডিটাকে। দুমিনিট দাঁড়িয়ে থাকলো। একবার ভাবলো প্লাস্টিক খুলে দেখে নেবে কিনা আদেও মেয়েটা কোনো প্রাকটিক্যাল জোকস করছে না তো? কিন্তু তা কি করে সম্ভব? ও তো গাড়ি থামায়নি কোথাও। শক্তিগড়ে যখন নেমেছিল গাড়ি লক করেই নেমেছিল। সারা শরীর ঘেমে উঠেছে পার্থর। মেয়েটা যা বললো তা যদি ওকে করতেই হয় তাহলেও এখানে কি করে পোড়াবে বডিটাকে? কি মনে করে আবার ডিকিতে ঢুকিয়ে নিলো বডিটাকে। গাড়ি স্টার্ট দিলো, ফোনে তখনো সেই আননোন নাম্বার।
"কি হলো, পোড়াবে না?"
"না, পুড়িয়ে দিলে তুমি যে আমার কাছে আর আসবে না। আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি যে।"
"পাগলামি করো না। আমি বেঁচে নেই। ছেলেদের ভালোবাসা দেখা হয়ে গেছে আমার। একরাতে সব মিলিয়ে আট জনের ভালোবাসা পেয়েছি। নিতে পারিনি। তাই ভালোবাসার কথা আর বলো না।"
"শোনো আমি বর্ধমান ব্যাক করছি। তোমাকে যেখানে নামলাম সেই হাই মাস্ট এর সামনে এসে দাঁড়াও প্লিজ।"
"কিন্তু আমরা যে একসাথে থাকতে পারবো না, কেন বুঝছো না, আমি আর এইদুনিয়ার না। এই শরীরের মেয়াদ যতদিন আমার এই ছায়ার মেয়াদ ও ততদিন। শরীরের মেয়াদ তো শেষ হবেই। ফ্রিজে রাখলেও শরীর থাকবে না, আমাকেও তখন যেতে হবে।"
"আচ্ছা আসো তো আগে। রাতটা তো একসাথে কাটাই। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আমি বর্ধমান ঢুকছি আবার।"
"ভয় পাবে না তো?"
"না হে, ভয় পাব না, ভালোবাসবো।"
পাঁচ মিনিটের মধ্যে পার্থর গাড়ি বর্ধমান স্টেশনের বাইরের এসে দাঁড়ায়। স্টেশনের আলোতে স্পষ্ট দেখতে পায় ওর গাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে সেই অপরূপ সুন্দরী। ইহলোকের কেউ এত সুন্দর হতে পারবে না এই ব্যাপারে পার্থ সিওর।
"কোথায় যাবে।" গাড়িতে উঠে জিগ্গেস করে পামেলা।
"চলো না, একটা প্ল্যান আছে।" পার্থ মুচকি হাসি দিল।
"একটা গান ধরবে?"
"গান তো আমি জানি না।"
"তুমি পেত্নী, তুমি সব জানো।"
"আচ্ছা, তোমার জন্য চেষ্টা করতে পারি। বলো কোন গান শুনতে চাও?"
"কাহী দূর জব শাম ঢল যায়ে!"
"আচ্ছা, গাইছি।"
পার্থ গিয়ারের উপর বাম হাত রাখল। পামেলা তার উপর নিজের হাত রেখে শুরু করলো। পার্থ অনুভব করলো পামেলার হাতটা বরফ ঠান্ডা।
গাড়ি তখন বর্ধমান পেরিয়ে দামোদরের উপরে কৃষক সেতুতে। আচমকা স্পিড বাড়িয়ে গাড়িটাকে বাম দিকে ঘুরিয়ে রেলিংয়ের দিকে নিয়ে গেল পার্থ।
"একি একি তুমি এটা কি করছো?"
মুহূর্তের মধ্যে রেলিং ভেঙে দামোদরের দিকে পড়তে শুরু করলো পার্থর দামি গাড়িটা।
পামেলার কোনো কথা কানে নিলো না পার্থ। গলা ছেড়ে গান করছে তখন ও।
"কাহি তো ইয়ে দিল কাহি মিল নেহি পাতে,
কাহিসে নিকল আয়ে জনমও কা নাতে,
ঘানি থি উলঝান, বৈরী আপনা মন,
আপনা হি হোকে সাহে দারদ পারায়ে,
দারদ পারায়ে।"
আস্তে আস্তে দামোদরের বুকে ডুবে গেল গাড়িটা।
আশেপাশে গাড়িগুলোর দরজা খুলে কিছু লোক বেরিয়ে এলো, কিন্তু কারোর কিছু করার নেই, ব্রিজের মাঝামাঝি জায়গা ভেঙে দামোদরের নীচে তলিয়ে গেছে গাড়িটা।
পরের দিন হেডলাইন হলো কাগজে, *মাঝরাতে ব্রিজ ভেঙে দামোদরে সলিল সমাধি*।
*গাড়ি থেকে এক পুরুষ ও এক অচেনা মহিলার বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার। গাড়ির মালিকের নাম পার্থ মুখার্জি। গাড়ি চালাচ্ছিলেন পার্থবাবু নিজেই। সিটবেল্ট লাগানো অবস্থাতেই তাকে পাওয়া গেছে। লাশের পরিচয় অজ্ঞাত। পুলিশের ধারণা হচ্ছে মেয়েটাকে খুন করে লাশ নিয়ে পালাচ্ছিলেন পার্থ মুখার্জি। কিন্তু কিভাবে মাঝরাতে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নদীতে পরে যায় গাড়িটি তার কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি প্রত্যক্ষদর্শীরা। পার্থ মুখার্জির পরিবারেরও কোনো হদিশ পাওয়া যায়নি।
আপাতত পার্থর ফ্ল্যাটেই থাকছে ওরা। নদী থেকে উঠে আসার পরে সোজা ফ্ল্যাটেই এসেছে। আজ ওদের ফুলশয্যা। ওদের দাম্পত্য জীবন ভালো কাটুক।