"ভাই শুনছ?"
"শুনেছি শুয়ে পরো, একটাও কথা বলো না, চুপ করে থাকো।"
ফিসফিস করে আমার আর প্রলয়ের মধ্যে কথা হলো। আমরা একটা পাতলা কম্বলের নিচে শুয়ে আছি পাশাপাশি। শুয়ে আছি অলিভ হাউসের মেঝেতে। আমাদের মতোই গোটা 40 ছেলে মেঝেতে বিছানা পেতে শুয়ে আছি। আমরা পূর্বরেলে ভারত স্কাউটস এন্ড গাইডসের রাজ্য প্রশিক্ষণ পার্ক, মধুপরে এসেছি ভারত স্কাউটস এন্ড গাইডসের জাতীয় স্তরের একটা পরীক্ষার, রাজ্যস্তরের রাউন্ড দিতে। সময় টা 2006 সালের জুন মাস।
মধুপুরের এই ট্রেনিং পার্ক বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে। মধুপুর থেকে উত্তর পশ্চিম দিকে একটু গিয়েই রেল লাইন দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গেছে, একটা গেছে উত্তরে দেওঘর, একটা পশ্চিমে গিরিডি। এই দুই লাইন যেখান থেকে বিভক্ত হচ্ছে সেইখানের মাঝে যে ত্রিভুজাকৃতি অংশ, সেটাতেই এই ট্রেনিং পার্ক। ট্রেনিং পার্কে ঢোকার রাস্তাটা গিরিডির দিকের রেললাইনে পেরিয়ে যেতে হয়। ওই একটাই প্রবেশ পথ। যে সময়ের গল্প তখন প্রবেশ দ্বার দিয়ে ঢুকে মোরাম বিছানো রাস্তার বাঁ দিকে বেশ কিছু পাকা ঘর, সোজা গিয়ে রান্নাঘর ও রান্নাঘরের ডান দিকে, দেওঘরগামী রেল লাইনকে পিছনে রেখে আরো দুটো ঘর। এই দুটোর মধ্যে একটা হলো অলিভ হাউস। স্কাউটিং প্রতিষ্ঠাতা শ্রী ব্যাডেন পাওয়েলের পত্নীর নামে। ওপর ঘরটি অবশ্য ব্যাডেন পাওয়েলের নামে বিপি হাউস নামেই পরিচিত। তখন আমাদের মানে বাচ্চাদের থাকার জন্য এইদুটো ঘরেই থাকতে দিত। বিপি হাউসে বিছানা ছিল শোয়ার জন্য, কিন্তু অলিভ হাউসে মেঝেতেই বিছানা পেতে শুতে হতো। জায়গাটা শহর থেকে একটু দূরে হওয়ার জন্য আর মধুপুরের ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য দিনে প্রচন্ড গরম আর রাতের দিকে হাল্কা ঠান্ডা পড়তো। গোটা ট্রেনিং পার্ক জুড়ে প্রচুর গাছপালা রাতের পরিবেশকে বেশ ছমছমে করে দিত। সেই সময়ের ইলেকট্রিক পরিষেবাও তার জন্য কিছুটা অবশ্যই দায়ী।
তো মধুপুরের এই পরিবেশে বেশ কয়েক দশক ধরেই বিভিন্ন ক্যাম্পে বিভিন্ন ভয়ের ঘটনা ঘটেছে। তার বেশ কিছু গল্প রাতের অন্ধকারে গাছ তলায় বসে আরো গা ছমছমে পরিবেশে শুনতে বেশ ভালোই লাগতো, কিন্তু তারপর সেটার প্রভাব যে বাকি ক্যাম্পে চলতো সেটা বলাই বাহুল্য।
সেদিন রাতের ঘটনা টা তাহলে বলে শেষ করি। পরীক্ষা শেষ হওয়ার 1 দিন বাকি তখনও। ডিনার আমাদের রাত 8 টা তেই হয়ে যায়। তারপর ও কখনো কখনো পরীক্ষা চলে। আমার সেদিন রাতে একটা পরীক্ষা বাকি ছিল। ডিনারের পরে গৌতমদার কাছে পরীক্ষা দিতে গিয়ে দেখি ওখানে অন্য একটা জেলার প্রলয় বলে একটা ছেলে সবে পরীক্ষা শেষ করে ব্যাগ গোছাচ্ছে। শেষ পরীক্ষার্থী আমি। প্রলয় আমাকে জিজ্ঞেস করলো আমার জন্য দাঁড়াবে নাকি! একা ছিলাম দেখে বললাম দাঁড়াও তাহলে, একসাথে যাওয়া যাবে। পরীক্ষা দিয়ে যখন আমরা অলিভ হাউসে পৌছাই তখন রাত 11.30। রাত 10 টায় লাইট অফ হয়ে যায়, ক্যাম্পের নিয়ম। অলিভ হাউসে একটা এটাচ বাথ কাম টয়লেট আছে। সেটা রেল লাইনের সাইডে, মানে ঘরের উত্তর দিকে। ঘরে ঢোকে বেরোনোর জন্য 2 টো দরজা। দুটোই দক্ষিণ দিকে। তো এই দরজাটুকু ছেড়ে আমরা মেঝেতে বিছানা পেতে শুই। সাধারণত এই ধরণের ক্যাম্পে ব্যাগের ওজন কমাতে একটা কাজ আমরা করতাম। খুব বেশ চাদর, কম্বল নিতাম না। শেয়ার করে নিতাম পাশের ছেলেই সাথে। একজনের চাদর নিচে পাতা হতো, আর একজনের চাদর গায়ে ঢাকা দেওয়া হতো। প্রলয় বললো ওর একটা পাতলা কম্বল আছে, আমার একটা ডবল বেড সিট ছিল। আমি আর প্রলয় তাই ঠিক করলাম বেড সিটটা মেঝে তে পাতা হবে আর হটাৎ করে হওয়া বৃষ্টির জন্য যে ঠান্ডাটা পড়েছে তাতে গায়ে পাতলা কম্বলটা দেব।
ঘর তখন অন্ধকারই। একটা ছোট টর্চ জ্বালিয়ে দেখে নিলাম ফাঁকা জায়গা কোনটা আছে। বাঁ দিকের দরজা দিয়ে ঢুকে বাঁ আর ডান দিকের দরজার মাঝে ফাঁকা একটা জায়গা পেলাম। 5 মিনিট লাগলো বিছানা করতে। তারপর দরজা ভেজিয়ে বন্ধ করার দিলাম দুটোই, আমরাই শেষ ছিলাম ঘরে ঢোকার মতন। শুয়ে শুয়ে বেশ কিছুক্ষণ আগামীকালের পরীক্ষার বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম সেটা মনে নেই।
ঘুম টা হটাৎ করে কখন ভাঙলো সেটা বুঝতে একটু সময় লাগলো। ঘর একদমই ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঘরের বেশ কিছু ছেলে প্রবল ভাবেই নাক ডাকছে। কিন্তু আমার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটালো কোন মহাপুরুষ সেটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। কম্বল মুড়ি দিয়ে আবার ঘুমানোর তাল ঠুকচি এমন সময়ে বাথরুম থেকে একটা আওয়াজ শুনলাম। কে একজন ওখান থেকে বেরিয়ে আসছে। ভেজা চটির শব্দ শুনে বুঝলাম, কম্বল থেকে মুখ তুলে দেখিনি।
ঘুমটা ঠিক এলোনা। আনুমানিক 5 মিনিট পরে আবার কেউ উঠে বাথরুমে গেল। সে যাক, টয়লেট পেলে বাথরুমেই তো যাবে। দেড় দু মিনিট পরে ফিরেও এলো। কিন্তু ফিরে আসার শব্দটা আমার কেন জানি না চেনা লাগলো। হয়তো ওরকম ভাবে কাউকে হাঁটতে শুনেছি। সেটা মাথায় আসতেই চট করে মনে পরে গেল কোথায় শুনেছি। আরে এ তো সেই ছেলেটাই হবে, যে 5 মিনিট আগে একবার বাথরুম থেকে ঘুরে এলো। হ্যাঁ ওই হবে, পা টা একটু টেনে টেনে হেঁটে ফিরছিল যেন। তারপর মনে করার চেষ্টা করলাম ওরকম ভাবে কে হাঁটে এই জনা 40 এর মধ্যে?
না অনেক ভেবেও মনে পড়লো না, আসলে ঘুম টা আর আসছিল না, শেষে ভাবলাম একবার যাই আমি বাথরুম থেকে ঘুরে আসি। কিন্তু উঠতে ইচ্ছে করল না। আমাকে বেশ অবাক করে দিয়ে হটাৎ করে সেই পায়ের শব্দ আবার পেলাম। ছেলেটা যেই হোক আবার যাচ্ছে টয়লেটে। ভাবলাম উঠে দেখি। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে পারলাম না, ওর আবার ফিরে আসার শব্দ পেলাম। সেটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর পাশে শোওয়া প্রলয়কে হাল্কা ঠেলা মেরে জিজ্ঞেস করলাম গল্পের শুরুর প্রথম দুই লাইন। ও শুনেছে কিনা র উত্তরে যা বললো সেটা শুনে আমার কেন জানি না ভালো লাগলো না। এই আওয়াজ তাহলে ও শুনেছে। তাহলে হটাৎ করে চুপ করে যেতে কেন বলছে আমায়। ও কি কিছু জানে নাকি।
আমিও ফিসফিস করে বললাম "চুপ করবো কেন? ঘরে এতবার কে যাচ্ছে টয়লেট?"
"এই নিয়ে 7 বার হলো।"
"আমি তো 3 বার শুনলাম।"
"আমি অনেকক্ষন ধরেই শুনছি, জানিস যাওয়া আসার সময়ের মাঝের ব্যবধান কিন্তু একই। এইভাবে বার বার কেউ যেতে পারে না টয়লেট।"
"তাহলে? কেসটা কি?"
"আমিও ঠিক বুঝতে পারছি না, কিন্তু একটা ভয় ভয় করছে জানিস!!"
ভয়টা যে আমারও করছে সেটা ওকে আর বললাম না।
হটাৎ করে আবার সেই না-দেখা মানুষটি চটি পরে বাথরুমের দিকে চললো। আমার শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা একটা স্রোত নেমে গেল। প্রলয়ের হাতে হাত লাগতে সেটা অস্বাভাবিক ঠান্ডা লাগলো। ওর হাতটা একটু টিপে বললাম, "ভাই, এবার যখন ফিরবে আমরা দুজনেই একসাথে উঠে টর্চ জ্বালাবো! কি বলিস।"
প্রলয় বললো "ঠিক আছে, তিন গুনব, আমি গুনে দেখেছি ঠিক 8 সেকেন্ড থাকে সেই পায়ের আওয়াজ।"
আওয়াজটা ফিরতে শুরু করলো, আমি তিন গুনলাম। প্রলয়কে হাল্কা করে চিমটি কেটে কম্বল সরিয়ে উঠে বসে বাথরুমের দিকে তাক করে টর্চ জ্বালালাম।
কিন্তু কোথায় কে?
গোটা ঘরে কেউ দাঁড়িয়ে নেই।
সবাই ঘুমাচ্ছে।
কিন্তু এদিকে আমার পাশে প্রলয় টর্চ জ্বালেনি কেন? ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি প্রলয় আমার পাশে নেই। বিছানা ফাঁকা। ওর ফাঁকা বিছানার পাশে যাদের শুয়ে থাকার কথা ছিল তারা ঠিক শুয়ে আছে।
ঘাড়ের পাশ দিয়ে একটা ফিসফিস আওয়াজ ভেসে এলো, "কিরে টর্চ জ্বালালি না কেন, দেখ আমি কে বারবার বাথরুম যাচ্ছি? দেখবি না?"
আমি ঘাড় ঘুরিয়ে মেঝে তে টর্চ ফেলে দেখলাম নেই কেউ।
আওয়াজটা কানের কাছেই বললো আরে মেঝেতে না উপরে দেখ, উপরে দেখ।
আপনা আপনিই আমার টর্চ উপরের দিকে চলে গেল, সেখানে উল্টো হয়ে সিলিং এ চটি পরে হাঁটছে প্রলয়।
আমার আর কিছু মনে নেই।
2 দিন অজ্ঞান ছিলাম। জ্ঞান ফিরতে জেনেছিলাম আমি নাকি ঘরের মেঝের মধ্যেই জ্ঞান হারিয়ে পড়েছিলাম। মাঝ-রাতেই আমার মাথা ঘুরিয়ে পরার আওয়াজ পেয়ে সবাই ঘুম ভেঙে আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরে। আমি নাকি তখন কোন প্রলয়ের নাম নিচ্ছিলাম। এদিকে নাকি প্রলয় বলে সেই ক্যাম্পে কেউ আদেও ছিল না।
অনেক চেষ্টা করেছিলাম তারপর সেই প্রলয়কে খুঁজতে। ও যে জেলার নাম বলেছিল সেই টিমেও কেউ প্রলয়কে চিনতে পারেনি। গল্পটা কোনোদিন ও কাউকে আমি বলিনি। যাদের সামনে ঘটনাটা ঘটেছিল তাদের বলেছিলাম মাথা ঘুরে গেছিল।
আজ ও আমি সেই প্রলয়কে খুঁজে চলেছি। কি জানি কোন ঘরের সিলিং থেকে এখনো বাথরুম অবধি হেঁটে চলেছে।