বুকটুক প্রকাশনীর দুর্গাপুজো.com পূজাবার্ষিকী 2022 সংখ্যায় প্রকাশিত
বিশাল বড় স্কুল বাড়িটার বেশিরভাগ অংশ থেকেই সেরকম হল্লা শোনা যাচ্ছে না, গরমের অলস দুপুরে যেন সব পক্ষই কিছুটা বিশ্রাম নিচ্ছে। কিন্তু লম্বা করিডোরের শেষ প্রান্তের ক্লাসটা থেকে বেশ আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে, সম্ভবত করিডোরের শান্তি ভঙ্গ করার দায়িত্ব একার কাঁধে তুলে নিয়েছে ক্লাসরুমটা। পাশের ক্লাসরুম থেকে একজন শিক্ষককে বেরিয়ে শেষ ক্লাসরুমে ঢুকতে দেখা গেলো, মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে গেলেও যেই সেই শিক্ষক বেরিয়ে গেলেন অমনি আগের অবস্থায় ফিরে গেলো ক্লাসরুমটা। বোঝা যাচ্ছে যে, নির্দিষ্ট শিক্ষকের অনুপস্থিতির জন্য ওরা আপাতত স্বাধীনতা অর্জন করে নিয়েছে।
কিন্তু সে সুখ দীর্ঘস্থায়ী হবে না, কারণ হঠাৎ করেই করিডোর দিয়ে ডান হাতে একটা বেতের লাঠি, বাম হাতে চক ও ডাস্টার নিয়ে বেশ দ্রুত হেঁটে আসতে দেখা গেলো স্কুলের সবথেকে সিনিয়র শিক্ষক কুলদারঞ্জন পাঠককে। গন্তব্য শেষের ক্লাসরুম ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না। আশেপাশের ক্লাসরুম গুলোতে শিক্ষক উপস্থিত থাকলেও মাঝেমাঝে যেটুকু শব্দ ভেসে আসছিল পাঠকবাবুর পায়ের শব্দের সাথে সাথে সেগুলো মিলিয়ে যেতে থাকলো. পাঠকবাবুর এটাই মহিমা, একটা হাঁক পাড়লেই গোটা স্কুল একেবারে চুপ হয়ে যায়।
তাই শেষের ক্লাসটাতে পাঠকবাবু ঢুকতেই যে হল্লাটা হচ্ছিল, সেটা থেমে গেল। টিফিনটাইমের আগের ক্লাস, হওয়ার কথা ছিল অন্য একজন স্যারের বাংলা, কিন্তু এখন পাঠকবাবু এসেছেন মানে অঙ্ক শুরু হবে, আর একটু বেচাল হলেই গোটা টিফিন পিরিয়ড মাঠে না খেলে, নিল ডাউন হয়ে কাটিয়ে দিতে হবে ক্লাসরুমের সামনেই। তাই, পাঠকবাবুকে দেখেই গোটা ক্লাসরুমে যে নিরবতা নেমে এলো, সেটা হয়তো পিন ড্রপ সাইলেন্সেরই সংজ্ঞা। মফস্বলের বাংলা মিডিয়াম স্কুল, তাই এখানে স্যার ঢুকলেই গুড মর্নিং স্যার, বলার চলটা নেই। উল্টে নীরবতাই সন্মান জানানোর অন্যতম উপায়।
পাঠকবাবু একটু অখুশিই হলেন, অন্যসব স্যারদের মতন উনি কখনোই হল্লা করা ক্লাসরুমকে মাছের বাজার মনে করেন না। বরং একটু হল্লা হলেই উনার ভাল লাগে। বেশ আরামে পেটানো যায়। তারপর টিফিন পিরিওডে নিল ডাউন। ব্যাস, এর বেশি শাস্তি উনি কখনোই কাউকে দেননি। পাঠকবাবুর রিটায়ারমেন্টের বেশি দেরি নেই, এ বছরের শেষেই অবসর নেবেন। এই নিরব হয়ে যাওয়া ক্লাসরুমকে দেখে সত্যিই উনার মন খারাপ হয়ে যায়। আর গোটা স্কুল এটা জানে বলেই পাঠকবাবুর সামনে সবরকম দৌরাত্ম বন্ধ রাখে। কার ই বা ইচ্ছে করে টিফিন পিরিয়ডটা নিল ডাউন হয়ে কাটিয়ে দিতে!
পাঠকবাবু ভাবতে থাকেন, নাহ ছেলেগুলো আগের মতন নেই, আগে একদিন পিটান খেলেও অনেক ছেলেই ছিল যারা পরের দিনও একই কাজ করতো আর সেম ভাবেই মার খেত। আর এখন! একজনকে মারলে গোটা স্কুলে আর এক সপ্তাহ কাউকেই পান না মারার মতন। ছেলেগুলো এতই ভয়ে থাকে, টিফিন পিরিয়ডেও ওঁর সামনা সামনি কেউ আসতে চায় না।
“এই সাত নম্বর অধ্যায়ের তেইশ নম্বর অঙ্কটা সবাই খাতায় করে আমাকে দেখা।” বলেই কাঠের চেয়ারে বসে পায়ের উপর পা তুলে দিয়ে ক্লাসের সব ছেলেগুলোকে মেপে নিতে শুরু করে দিলেন কুলদারঞ্জন পাঠক।
দু মিনিটের মধ্যেই ফার্স্ট বয়, অমিত এসে অঙ্কটা দেখিয়ে দিয়ে গেল। তারপর একে একে সবাই আসতে শুরু করলো নিজের নিজের খাতা নিয়ে, কিন্তু পাঠকবাবুর নজর ডান দিকের তিন নম্বর বেঞ্চের মাঝে বসা ছেলেটার উপরে। এতদিনের অভিজ্ঞতা থেকে উনি জানেন ঐ হতচ্ছাড়াটা অঙ্কটা পারবে না। শিখিয়ে অবশ্যই দেবেন পাঠকবাবু ওঁকে, কিন্তু তার আগে হাতের সুখ না করলে চলে?
সবার মোটামুটি দেখানো হয়ে গেলে পাঠকবাবু ছেলেটার দিকে নজর ঘোরালেন। গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলেন, “ওই ! তোর নাম শুভেন্দু না? অঙ্কটা করেছিস? খাতাটা দেখি?”
শুভেন্দু বেচারা খাতা না নিয়েই উঠে এলো, ভেবেছিল বেঁচে যাবে, পাঠকবাবু অতোটাও খেয়াল করবেন না। যদিও গোটা স্কুল জানে, পাঠকবাবুর শকুনের চোখ, ভাগাড়ের মরা খোঁজার মতন করে কে ক্লাস করছে না তাকে খুঁজে নেয় তবুও শুভেন্দুর মনে একটু হলেও আশা ছিল যে পাঠকবাবু ওকে হয়তো ধরতে পারবেন না। এমনিতে শুভেন্দু পড়াশোনায় ভাল, কিন্তু সমস্যা হলো, যেকোনো বিষয়ে টেনশন নিয়ে নিলে ও ঘাবড়ে যায়। অঙ্কটা না পারার মতন ছিল না, এমনকি আশেপাশের সবাই এর ওরটা দেখেই করেছে, চাইলে শুভেন্দুও পাশে বসা সায়নের থেকে দেখে নিতে পারতো, কিন্তু পাঠকবাবুকে ঢুকতে দেখেই ওর যে টেনশনটা হয়েছে তাতেই সব গোলমাল ঘটে গেছে।
পাঠকবাবু অবশ্য শুভেন্দুকে বেশি কেলালেন না, শুধু মাথাটা টেবিলের তলায় ঢুকিয়ে পিঠে চারটে কিল খেয়ে ক্লাসরুমের বাইরে নিল ডাউনের শাস্তি দিয়ে দিলেন। অর্থাৎ টিফিন পিরিয়ডটা পুরোটাই থাকতে হবে ওকে ঐভাবে। মনের কষ্টে চোখে জল চলে এলো শুভেন্দুর, কালই একটা নতুন বল কিনে আজ সেটা স্কুলে এনেছিল টিফিন পিরিয়ডে খেলবে বলে, এবার সব শেষ. পাঠকবাবুকে দেখে যে কেন ও টেনশন নিয়ে নিলো, সেটাই বুঝতে পারলো না। এদিকে চোখের জল বাঁধ মানছে না, শুভেন্দু কেঁদেই যাচ্ছে, একদিকে বলের দুঃখ, অন্যদিকে পিঠে ব্যাথা..
“এই কি হয়েছে তোমার? কাঁদছো কেন?”
হটাৎ করেই রুমির ডাকে ঘুম ভেঙে গেল শুভেন্দুর। ধরমড়িয়ে উঠে বসলো। কোথায় ক্লাসরুম? আর কোথায় পাঠকবাবু? পাশে তাকিয়ে দেখলো রুমী মানে ওর স্ত্রী অবাক হয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
“তুমি কোনোও স্বপ্ন দেখছিলে কি? কাঁদছো কেন? কি দেখেছ আমায় বলো।” রুমির সস্নেহ প্রশ্নগুলো ধেয়ে এলো। প্রশ্নের সাথে সাথে সস্নেহে জলের বোতলটাও এগিয়ে দিলো রুমি।
অনেকটা জল খেলো শুভেন্দু। মনে করার চেষ্টা করলো পুরো স্বপ্নটা। তারপর একটু সামলে নিয়ে যতদূর মনে পড়লো রুমিকে বললো।
হেসে উঠলো শুভেন্দুর স্ত্রী। “তুমি অঙ্ক পারোনি? তার জন্য মার খেয়েছ? ধুর এটা হতেই পারে না।” রুমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইলো না। অবশ্য কি করেই বা বিশ্বাস করবে? শুভেন্দু অঙ্কে আইআইটি থেকে পি-এইচ-ডি করেছে, এই মুহূর্তে ও কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্কের প্রফেসর। আর সেই শুভেন্দু কিনা ক্লাস সেভেনে থাকতে অঙ্ক না পারার জন্য এমন মার খেয়েছে যে সেটা আজ এতো বছর পরে দুঃস্বপ্ন হয়ে ফিরে এসেছে?
“আচ্ছা, ওটাই কি একমাত্র মার খেয়েছ তুমি? মানে এটো বছর পরে ঐ ঘটনাটা তোমার স্বপ্নে আসছে। কি ব্যাপার বলোতো?” রুমি প্রশ্ন করলো।
একটা সিগারেট ধরিয়ে ওর ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে গিয়ে বসলো শুভেন্দু। নিচে যে কল্যাণী শহরটাকে দেখা যাচ্ছে সেটা পুরোই ঘুমে ডুবে। সামনের রাস্তাটা হলুদ আলোয় আলোকিত, দু তিনটে কুকুর শুয়ে আছে, স্ট্রিট ফুডের ট্রলিগুলো ত্রিপল দিয়ে ঢাকা।
স্মৃতির অতলে ডুব দিয়ে স্কুলের কথাগুলো মনে করার চেষ্টা করে শুভেন্দু বললো, “না, না, তা হবে কেন? মার কি কম খেয়েছি নাকি আমি। স্কুলে ভদ্র বলে কোনো রেপুটেশন আমার ছিল না কোনদিনও। আসলে কি জানো আমি না কিছুতেই মনে করতে পারছি না আমি সেদিন পাঠকবাবুকে দেখে টেনশনে কেন পড়ে গেছিলাম, টেনশনটা না হলে অঙ্কটা নিশ্চয়ই পারতাম। কিছুতেই মনে আসছে না অঙ্কটা কি ছিল। আমি টেনশনে না পড়লে কিন্তু অঙ্কটা করে দিতাম।”
রুমি ততক্ষণে শুভেন্দুর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, বললো, “সে না হয় ঠিক আছে, স্বপ্নে পারোনি, বাস্তবে নিশ্চয়ই পারবে। কাল সকাল হলে তোমার পাঠকবাবুর কাছেই চলে যেও। উনি নিশ্চয়ই মনে করতে পারবেন যে কি অঙ্ক দিয়েছিলেন!”
শুভেন্দু একটু অন্যমনস্ক হয়ে পরেছিলো, রুমির কথায় সম্বিত ফিরে পেয়ে বললো, “কি বললে? পাঠকবাবুর সাথে দেখা করে অঙ্কটা জেনে নেব?”
“হ্যাঁ! উনি তো নামকরা শিক্ষক ছিলেন, ওঁর বাড়ি নিশ্চয়ই তুমি চেনো। কাল একবার ঘুরেই এসো ওঁর বাড়ি থেকে।”
“সে আর সম্ভব নয়।” একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো শুভেন্দু, “স্যার অনেকদিন হলো গত হয়েছেন। তাছাড়া আমি ওঁর বাড়িটা চিনলেও কোনদিনও যাইনি আগে। যাওয়া উচিত ছিলো, আজ আমি যেটুকু অঙ্ক পারি সেগুলোর বেস উনিই বানিয়ে দিয়েছিলেন। জানো, আমার ক্লাস নাইন অবধি কোনো প্রাইভেট টিউটর ছিলো না, যা শেখার আমি স্কুলেই শিখেছি। কিন্তু কি আশ্চর্য দেখো, স্কুলের এতো কাছে প্রফেসারী করেও আমি স্কুল ছাড়ার পরে একদিনের জন্যও স্কুলে যাইনি। স্কুল থেকে শুধু নিয়েই গেছি, ফেরত কিছু দিইনি আজ অবধি। ”
রুমী ওর হাতটা ধরে বললো, “সে তো নিরানব্বই শতাংশ পাশ আউটই স্কুলে আর যেতে পছন্দ করে না। বাদ দাও ওসব কথা, উনি যখন নেই তখন আর স্বপ্নে দেখা অঙ্কের জন্য রাতের ঘুম নষ্ট করার দরকার আছে কি?” রুমির কথাতে শুভেন্দুর মনে হলো, ও একটু বেশিই নস্টালজিক হয়ে পড়েছে আর তার সাথে স্বপ্নটার বেশিরভাগটাই আর মনে করতে পারছে না।
“যাক ভালই হলো।” মনে মনে ভাবল শুভেন্দু, অঙ্কের সমাধান না পেলে ওঁর ঘুম আসেনা। এক্ষেত্রে অঙ্কটা মনে পড়ছে না, অতএব সেটা আর ঘুমের বারোটা বাজাতে পারবে না! তাই বাথরুম থেকে টয়লেট করে এসে আবার ঘুমিয়ে পড়লো শুভেন্দু।
পরের দিন সকালে নিজের অফিস রুমে বসে চা খাচ্ছে এমন সময় ঘরে ঢুকলো অর্ক।
“তোর এখন কোনো ক্লাস আছে?” ঢুকেই শুভেন্দুর সামনের চেয়ারে বসে প্রশ্নটা করে ফেললো অর্ক।
অর্ক সেনগুপ্ত কল্যাণী সরকারী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের আর্কিটেকচার ইন্জিনিয়ারিংয়ের প্রফেসর। অর্ক শুভেন্দুর স্কুলের ব্যাচমেট, স্কুল জীবনে অতটা ক্লোজ সম্পর্ক না থাকলেও চাকরি সুত্রে ওদের কাজের জায়গা পাশাপাশি। স্কুল শেষ করে দুজনে দু লাইনে পড়াশোনা করলেও এই মুহূর্তে ওদের বন্ধুত্বটাকে বেশ গভীর বলা যেতে পারে।
“কেন কোথাও যাবি?” ফ্লাক্স থেকে ডিসপোসাল কাপে চা ঢেলে একটা কাপ অর্কর দিকে গিয়ে দিয়ে বললো শুভেন্দু।
“হ্যাঁ, যাবো তো। একটা হেভি জায়গায় যাবো। একটা দুর্দান্ত সারপ্রাইজ আছে তোর জন্য।” চায়ে চুমুক দিয়ে বললো অর্ক।
“সারপ্রাইজ মানেই তো কোনো না কোনো দুর্দান্ত ডিজাইনের পুরোনো বাড়িতে নিয়ে যাবি, আর সেটা ভেঙে কি করে মডার্ন আর্কিটেকচারের নামে উদ্ভট স্টাইলের বিচ্ছিরি বাড়ি বানাবি সেটার প্ল্যানিং দেখানো। তাই তো?”
অর্ক আর্কিটেকচারের প্রফেসর হওয়ার কারণে বাইরে একটা কনসালটেন্সিও চালায়। কল্যাণীতে প্রচুর বড়লোকের বাস হওয়ার জন্য বিভিন্ন ডিজাইনের বাড়ি করার একটা চল আছে। অর্ক ওরকমই দুটো প্রমোটারের কনসালটেন্ট হিসাবে মাঝে মাঝে কাজ করে। তাতে যে পয়সা আসে সেটা বন্ধুবান্ধবদের পার্টি দিয়েই খরচ করে দেয়। তবে নতুন কোনো জায়গায় যাওয়ার আগে অর্ক বরাবরই শুভেন্দুকে নিয়ে যায়, কেন নিয়ে যায় সেটার কোনো কারণ ওরা দুজনেই অবশ্য জানে না!
“উহু! আজকের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা, বুঝলি!” অর্ক বললো, “তুই শুধু আমার সাথে যাবি কিনা বল। গেলে যে সারপ্রাইজটা পাবি সেটার গুরুত্ব এখন বললে বুঝতে পারবি না।”
“সে তো তুই ভালোই জানিস যে তুই বললে আমি না করতে পারবো না। ঠিক আছে চল, আমার এমনিতেও এখন কোনো ক্লাস নেই।”
চা শেষ করে দুজনে অর্কর গাড়িতে উঠে বসলো। অর্ক নিজেই ড্রাইভ করে, গাড়ি চালাতে ওঁর ভালোই লাগে। গাড়িটা ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে সোজা কল্যাণী স্টেশনের দিকে রওনা দিলো।
“এই তোর পাঠকবাবুকে মনে আছে?” শুভেন্দু হঠাৎ করেই প্রশ্ন করলো।
“কোন পাঠক স্যার? স্কুলের কুলদারঞ্জন পাঠক? অঙ্ক করাতেন?” অর্ক রাস্তার দিকে চোখ রেখে পাল্টা প্রশ্ন করলো।
“হ্যাঁ রে, আমাদের পাঠক স্যার। আমরা যখন নাইনে উনি রিটায়ার করলেন। হেভি কেলাতেন।”
“হ্যাঁ, মনে আছে তো। ঠিক টিফিনের আগের ক্লাসগুলোতে আসতেন। অঙ্ক না পারলে টিফিন পিরিওডকে মায়ের ভোগে পাঠিয়ে দিতেন। কিন্তু হটাৎ করে তোর পাঠকবাবুর কথা কেন মনে পড়লো রে, উনি মারা গেছেন না?” ভ্রু দুটো কুঁচকে প্রশ্ন করলো অর্ক।
“হ্যাঁ, মারা গেছেন দুহাজার পনেরো নাগাদ। আসলে কাল রাতে একটা স্বপ্ন দেখেছি জানিস! পাঠকবাবুকে নিয়ে। বিচ্ছিরি একটা স্বপ্ন। ক্লাস সেভেনে আমরা কোন ক্লাসরুমে বসতাম মনে আছে?”
“সম্ভবত মনে আছে। ঐ তো করিডোরের শেষ যে ক্লাসরুমটা ছিলো ওটাতেই তো ক্লাস সেভেনে আমরা পড়তাম, তাই না?”
“হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস। জানিস দেখলাম, আমরা ক্লাসে বসে আছি, সম্ভবত অন্য কোনো সাবজেক্টের ক্লাস ছিলো, তার টিচার আসেনি, তাই পাঠকবাবু ক্লাসে এলেন। মানে পাঠকবাবুর ক্লাস ছিলো না ওটা। তারপর ক্লাসে ঢুকে কি একটা অঙ্ক করতে দিলেন। সবাই পারলো কিন্তু আমি পারলাম না, আর কেলান খেয়ে গেলাম। ব্যাস, টিফিন পিরিওডটাও মায়ের ভোগে গেল।”
শুভেন্দুর স্বপ্নের কথা শুনে অর্কর চোখ বড় হয়ে গেলো, যেন প্রচন্ড অবাক হয়েছে এমন ভাবে বললো, “বলিস কি? তুই অঙ্ক পারিসনি? এটা হতেই পারে না। এমন কোন অঙ্ক দিয়েছিল যে তুই পারলি না?”
“অঙ্কটাই তো মনে করতে পারছি না, বুঝলি! রাতে ঘুম ভেঙে যাওয়ার পরে অনেকবার ভাবলাম অঙ্কটা নিয়ে, কিন্তু মনেই এলো না।”
অর্ক একটু সময় নিয়ে কি একটা ভেবে প্রশ্ন করলো, “কিসের অঙ্ক ছিলো? মানে জ্যামিতি জাতীয় কিছু ছিলো কি?”
“উহু, স্বপ্নে ওতো কিছু দেখিনি, কেলান খাওয়াটাই শুধু মনে আছে। ছাড় বাদ দে, কোথায় যাচ্ছি খুলে বল তো ভাই।” শুভেন্দু ব্যাপারটা নিয়ে আর এগোতে চাইছে না। এমনিতেই একটা তিল পেলেই অর্ক সেটাকে তাল করে দেয়, আর এখানে শুভেন্দুর অঙ্ক না পারাটা তো ওর কাছে একটা বিশাল বড় ঘটনা।
“বলছি বলছি, তার আগে একটা প্রশ্নের উত্তর দে তো? তুই অঙ্ক পারিসনি এরকম আমাদের পুরো স্কুল জীবনে হয়েছে কিনা আমি তো মনে করতে পারছি না। তুই ভাল করে ভেবে বল তো, কি এমন অঙ্ক দিয়েছিল যে পারিসনি?” অর্কর কথা শুনে শুভেন্দুর মনে হলো, ও স্বপ্নের ব্যাপারটা বলে ভুল করে ফেলেছে। এবার যতক্ষণ ওরা একসাথে থাকবে ততক্ষণ এটা নিয়েছি চলবে।
শুভেন্দু এবার একটু বিরক্ত হয়ে বলল, “বাবা, তুই আজকাল স্বপ্ন বিশেষজ্ঞ হয়ে গেলি নাকি? আরে যেটা পারিনি, সেটা আবার মনে করতে যাবো কেন? তাছাড়া আমি কি দেখেছি সেটা অনেকাংশেই ভুলে গেছি।”
তবে কথাটা বলার পরেই মনে হলো ওর মনের মধ্যে স্বপ্নটা নিয়ে যে খোঁচাটা আছে সেটা একবার অর্কর সাথে ডিসকাস করা যেতেই পারে। তাই আবার নিজে থেকেই বললো, “তবে একটা জিনিস বার বার মনে হচ্ছিল জানিস?”
“কি?” অর্ক প্রশ্ন করলো।
“অঙ্কটা মনে হয় খুব সোজা ছিল জানিস, আমিও পারতাম, সবাই পারছিল, এমনকি শুভময়, ঐ মালটাও পেরেছিল, ভাব তুই একবার। কিন্তু তাও যে কেন করলাম না সেটাই বুঝতে পারছি না।”
শুভময় ওদের ব্যাচমেট। ছেলেটার স্কুলে একটা রেকর্ড ছিল, একবার ও ফেল না করে অথচ প্রত্যেকবার সবথেকে কম নম্বর পেয়ে ছেলেটা স্কুলজীবন শেষ করেছিল। এখন এলাকার বড় নেতা, ওঁর কথা তাই ওদের সবার স্পষ্ট মনে থাকে।
“সেই জন্যই তো প্রশ্নটা করছি, ব্রাদার। ঐ গাম্বাটটা পেরেছিল, আর তুই পারিসনি! এটা হতেই পারে না। অঙ্কটা মনে করার চেষ্টা কর দেখি।” কল্যাণী মেন স্টেশনের সামনে থেকে রাইট টার্ন নিতে নিতে বললো অর্ক।
“আচ্ছা, তুই এত মাথা ঘামাচ্ছিস কেন রে, যদ্দুর মনে পড়ে অঙ্ক বিষয়টাকে তো তুই অতোটা ভালবাসতিস না?” শুভেন্দু এবার পাল্টা প্রশ্ন করলো।
স্টেশন পেরিয়ে যে রাস্তাটা লেভেল ক্রসিংয়ের দিকে যাচ্ছে ঐ রাস্তাতে তখন এসে পরেছে ওদের গাড়ি. শুভেন্দু প্রশ্নের উত্তরে অর্ক একটা রহস্যের হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে বললো, “কারণ কাল রাতে পাঠকবাবু আমার স্বপ্নেও এসেছিল!”
অর্কর কথা শুনে ভিরমি খেল শুভেন্দু। চোখ বড় বড় করে প্রশ্ন করলো “বলিস কি?”
মুখের ভাবে রহস্য বজায় রেখে অর্ক বললো, “হ্যাঁ রে, আমার স্বপ্নটা অবশ্য অন্য ছিল। তোর মনে আছে জোনপুর পেরিয়ে আমরা একটা মন্দিরে আড্ডা দিতে যেতাম? একটা ঝিলের পাশে মন্দিরটা ছিল।”
“হ্যাঁ, মনে আছে তো। কুলিয়াপাঠের অপরাধভঞ্জন মন্দির। সে সব আলাদাই দিন ছিল বল! পুকুরে স্নান করে ভেজা প্যান্টে মন্দিরের চাঁতালে বসে কত আড্ডা মেরেছি বল। কিন্তু পাঠকবাবু তোকে স্বপ্নে ওখানে দেখা দিয়েছে নাকি!” শুভেন্দু তখনো অর্কর দিকে তাকিয়েই আছে।
ওদের গাড়ি এখন রেলের লেভেল ক্রসিংয়ে আটকে আছে, সামনে দিয়ে শিয়ালদা কল্যানী লোকাল ধীর গতিতে পাস হচ্ছে আর শুভেন্দু মনে পড়ে যাচ্ছে স্কুল জীবনের আনন্দের দিনগুলো।
“তোর মনে আছে তাহলে! ঐ মন্দির থেকে একটু এগিয়ে ডান দিকে মানে এখন যে রাস্তাটা দিয়ে কল্যানী এইমস এ যাওয়া হয় সেই রাস্তার পাশে একটা জঙ্গল ঘেরা জমি ছিল, সেটা মনে আছে?” হাত দিয়ে ইশারা করে জায়গাটা বোঝানোর চেষ্টা করলো অর্ক।
শুভেন্দুর মনে পড়লো না ওরকম কোনো জায়গাতে ও গেছিল কিনা কখনো। বললো, “নাহ তো, ওরকম কিছু ছিল নাকি? আসলে মন্দিরের আগে আমি কখনো যাইনি। আমার দৌড় মন্দির অবধিই। তোরা যেতিস নাকি?”
“না রে। স্কুল লাইফে কোনদিন ও যাইনি। তবে ইদানিং অনেকবারই আমাকে যেতে হয়েছে। ওখানেই একটা বড় প্লটে চারটে বাড়ি উঠছে, আমারই ডিজাইন করা। মোটের উপর জায়গাটা এখন আমার বেশ পরিচিত। কাল অবশ্য স্বপ্নে ওখানে আমি গেছিলাম। তাহলে তোকে আমার স্বপ্নটা বলি শোন।” অর্ক বলা শুরু করলো,
“আমি স্বপ্নে দেখলাম, আমরা প্রায় সাতজন মন্দিরের ঝিলে স্নান করে চাঁতালে বসে আছি। তোর নিশ্চয়ই প্রীতমকে মনে আছে, ওই যে মদনপুর থেকে আসতো, শেষে প্রেমে লাথ খেয়ে পাগল হয়ে গেলো!”
“হ্যাঁ মনে আছে। তারপর বল!”
“আমরা আড্ডা মারছি, এমন সময় প্রীতম দু প্যাকেট বিড়ি নিয়ে এলো। এবার বিড়ি তো আর মন্দিরে খাওয়া যাবে না আর সবথেকে বড় সমস্যা হলো আমরা স্কুলের ইউনিফর্মে আছি, তাই সবাই মন্দির থেকে বেরিয়ে একটা সেফ প্লেস খুঁজতে গিয়ে ঐ জঙ্গলটা পেলাম। বিড়ি খাওয়া হয়ে গেলে, সবাই বেরিয়ে যাবো, এমন সময় আমি টয়লেট করার জন্য জঙ্গলের একটু ভিতরে ঢুকেছি আর সামনে দেখি পাঠকবাবু! আমি তো উনাকে দেখে চমকেই উঠলাম, ভয় ও পেয়ে গেলাম, এই বুঝি স্কুল পালিয়ে ঘুরে বেড়ানোর জন্য স্কুল থেকেই না বার করে দেয়। বিড়িও নিশ্চয়ই খেতে দেখেছে। স্যার ও দেখি এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।
আমি তো বিশাল আতঙ্কে আছি, মুখ থেকে কথা বেরোচ্ছে না, এদিকে স্যার একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আমার তো অবস্থা পুরো টাইট। ভাবলাম ছুটে পালিয়ে যাই, কিন্তু পারলাম না। তারপর তো অনেক কষ্টে মনে অনেক সাহস এনে স্যারকে প্রশ্ন করলাম যে উনি এখানে কি করছেন!
“তারপর?”
“পাঠকবাবু দেখলাম রাগ করলো না, বকাবকি ও করলো না. শুধু আমার দিকে ঐভাবে তাকিয়ে থেকেই বললো যে উনি একটা জিনিস রাখতে এসেছেন!”
“হ্যাঁ!” শুভেন্দু অর্কর গল্পের মাঝপথে ওকে থামিয়ে প্রশ্ন করলো, “কি জিনিস?” ইতিমধ্যে লেভেল ক্রসিং গেট খুলে গেছে।
লেভেল ক্রসিং বন্ধ থাকার জন্য একটু জ্যাম হয়ে গেছিলো, সেসবকে পাস করে গাড়িটা আবার ফাঁকা জায়গায় এলে অর্ক বললো, “আরে সেটা আমিও জিজ্ঞেস করলাম। বললো না জানিস। বললো জিনিসটা নাকি উনি পুঁতে রেখেছেন। আর খুঁজে পাচ্ছেন না। আমি বললাম স্যার, কোনো নিশানা দিয়ে রাখেননি? বললো, হ্যাঁ, নিশানা আছে। তারপর এমন একটা কথা বললো, সেটা শুনেই আমার..”
“কি..কি বললেন উনি?”
“বললেন যে জিনিসটার নিশানা শুভেন্দু জানে। ওকে জিজ্ঞেস করলে পাবি।”
“মানে?”
“আরে মানেটাই তো আমি বুঝে ওঠার আগেই স্যার গায়েব!”
“শুভেন্দু মানে কি আমার কথা বললেন উনি? এ তো বিশ্বাসই করা যাচ্ছে না। তারপর কি হলো?” অবিশ্বাসের সুরে প্রশ্ন করলো প্যাসেঞ্জার সিটে বসা কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্কের প্রফেসর শুভেন্দু সেন।
“তারপর আর কি? ঘুমটা ওখানেই ভেঙে গেল। দ্যাখ, আমি গোটা দুই শুভেন্দুকে চিনি, তাদের মধ্যে তুই একজন। অন্যজনের সাথে পাঠকবাবুর কোনো সম্পর্ক নেই, তাই সকালে তোর কাছেই আগে গেলাম।” ব্যাপারটা নিয়ে অর্ককে একটু বিচলিত মনে হলো।
“ওহ ! ঐ জন্যই তুই আমাকে নিয়ে ঐ জায়গাটায় যাচ্ছিস।” উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করলো শুভেন্দু!
“অনেকটা তাই। আসলে আমি তো জানতাম না পাঠকবাবু তোর স্বপ্নেও এসেছিল। ইনফ্যাক্ট আমি তো জানতামই না পাঠকবাবু মারা গেছেন। সকালে উঠেই আমি খবর নিয়ে জানতে পারি যে উনি অনেকদিন হলো মারা গেছেন। আমি তো প্রথমে ভেবেছিলাম যে ওঁর সাথে গিয়ে দেখা করে আসবো, কারণ স্কুল ছাড়ার পর তো আর কোনো স্যারের সাথেই দেখা করিনি। তারপর যখন জানতে পারলাম যে উনি আর নেই তখন রাতে দেখা স্বপ্নের উপরই কনসেনট্রেট করলাম। আমি তো আমার স্বপ্নের বেসিসেই তোকে নিয়ে যাচ্ছিলাম। ব্যাপারটা আমার কাছে খুবই হাস্যকর লাগছিল সকালে, যখন পুরো ব্যাপারটা ভাবছিলাম। তোকে তাই শুরুতে কিছু বলিনি। রাস্তাতেই বলব বলে ঠিক করেছিলাম। আমি তো ভেবেছিলাম তুই গোটা জিনিসটাকেই হেসে উড়িয়ে দিবি, ভাববি আমি ভাট বকছি। তখন তো আর জানতাম না, সত্যিই তোর কাছে ঐ নিশানাটা রয়েছে, যাতে করে পাঠকবাবু কি খুঁজছিল সেটা পাওয়া যাবে।” শুভেন্দুর দিকে তাকিয়ে বললো অর্ক।
“কিন্তু আমার কাছে সত্যিই কিছু নেই। তোকে তো বললাম আমি কি কি দেখেছি!”
“আরে ঐটুকুই অনেক। ওখান থেকেই আমরা নিশানা পাবো। তোর স্বপ্নের গল্পটা শুনে আমার মনে হয়েছে যে আমদের দেখা স্বপ্ন দুটো ইন্টারকানেক্টেড! এবং তোকে উনি স্বপ্নে এসে যে অঙ্কটা দিয়ে গেছেন তার একটা বিশেষ ভূমিকা নিশ্চয়ই আছে। নইলে ভাব তুই অঙ্ক না পারার জন্য মার খাচ্ছিস এটা কি হতে পারে? সেই জন্যই বলছি, অঙ্কটা মনে কর। অঙ্কটাই নিশানা, ওটাই সুত্র হতে পারে।”
“কি বলছিস! যে অঙ্কটা আমি পারিনি, সেটার উপর বেস করে পাঠকবাবু কিছু লুকিয়েছিলেন?”
“আশ্চর্য হওয়ার কি আছে? ভেবে দেখ, উনি দুর্দান্ত অঙ্ক করাতেন। হয়তো গুপ্তধন জাতীয় কোনো জিনিস লুকিয়ে রেখে গেছিলেন ঐ জঙ্গলে কোথাও, কোনো একটা অঙ্কের সমাধানে হয়তো ঐ জায়গাটার নির্দেশ আছে। এখন উনি চান আমরা সেটা খুঁজে বার করি। তাই তো স্বপ্নে আসছেন। আর অঙ্কের সুত্র ধরে জিনিস খুঁজে বার করার জন্য উনি কিন্তু খারাপ লোককে বাছেননি তাই না? ভেবে দ্যাখ! তুই অঙ্কের প্রফেসর আর আমি হলাম আর্কিটেক্ট। উনি তোর স্বপ্নে এসে এমন অঙ্ক দিলেন যে অঙ্কটা না পারার জন্য তুই বিব্রত হবি, অর্থাৎ অঙ্কটা মনে রেখে তার সমাধানের চেষ্টা করবি। আর আমাকে স্বপ্নে এসে জায়গাটা দেখিয়ে চলে গেলেন। উল্টোটা করলে কিন্তু হতো না, আমাকে স্বপ্নে এসে অঙ্ক দেখালে আমি ওটা মাথাতেই রাখতাম না। কিন্তু তুই রাখবি, কারণ জীবনে একটা অঙ্কও তুই ভুল করিসনি। এবার তুই অঙ্ক কষে জায়গাটা বলবি, আমি মাটি খুঁড়ে গুপ্তধনটা বার করবো!”
অর্কর কথা শুনে এবার শুভেন্দু হেসে উঠলো, বললো “গুপ্তধন? পাঠকবাবুর? শোন ইয়ার্কির একটা লিমিট থাকে।”
“আরে না হওয়ার কি আছে? আমি সকালে জানতে পারলাম যে স্যার খুব কষ্টেই শেষ জীবনটা কাটিয়েছিলেন। একটাই ছেলে ছিল। ট্রেন থেকে নামতে গিয়ে মাথায় ট্রেনের দরজার বাড়ি লেগে পাগল হয়ে যায়, পেনশনের ম্যাক্সিমাম টাকা নাকি ওর ট্রিটমেন্টেই যেত। এমন তো হতেই পারে, এককালে খুব দামী কোনো জিনিস মাটির নিচে লুকিয়ে রেখে তারপর ভুলে গেছিলেন, সেটাই আমাকে আর তোকে দিয়ে খোঁজাচ্ছে। গল্পের বইতে পড়িসনি এরকম ঘটনা?” অর্ক বুঝিয়ে বললো, কেন ও ওদের স্বপ্নটাকে সিরিয়াসলি নিচ্ছে।
শুভেন্দু কথাটা শুনে বেশ কিছুক্ষণ ভাবলো, তারপর বললো, “পসিবল! তবে আমার স্বপ্নের একটা বিষয় তোকে বলা হয়নি।”
“কি বিষয়।”
“আরে আমি উনাকে দেখে ঘাবড়ে গেছিলাম। কেন ঘাবড়ে গেছিলাম সেটাই মনে পড়ছে না। যাই হোক, ঐ ঘাবড়ে গিয়েই আর অঙ্কটা করা হয়নি। সেই জন্যই তো মনে পড়ছে না রে অঙ্কটা।” স্বপ্নের পুরোটা অর্ককে বলতে পেরে স্বস্তি বোধ করলো শুভেন্দু।
“আচ্ছা চল, আগে ওখানে তো পৌঁছাই। যদি কিছু মনে পড়ে তো।” ওদের গাড়িটা তখন টিবি হাসপাতাল পেরোচ্ছে।
দু মিনিট কেউ কিছু বললো না। কুলিয়াপাঠের মন্দির পেরিয়ে কুলিয়া রোডের উপরে তিনশো মিটার উত্তরে এগিয়ে গাড়িটা দাঁড় করালো অর্ক।
“কেসটা পুরো বুঝলাম না, তুই কি করতে চাইছিস।” শুভেন্দু গাড়িতে উঠেই প্রশ্ন করলো।
“তোর কি অঙ্কটা মনে পড়েছে?” অর্ক পাল্টা প্রশ্ন করলো।
“না পড়েনি, কিন্তু যে অঙ্কটা করতে দিয়েছিল সেটা কোন চ্যাপ্টারের কত নম্বর সেটা মনে আছে।”
“ভেরি গুড। চল তাহলে।”
“কোথায়?”
“স্কুলে।” বলে অর্ক টিবি হাসপাতালের দিকে না গিয়ে জোনপুরের দিকে এগিয়ে চললো।
“স্কুল মানে? আমাদের স্কুলে যাবি?” বিস্মিত হয়ে শুভেন্দু প্রশ্ন করলো। জোনপুর পেরিয়ে কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ে ধরে কাঁপা মোড় থেকে ডান দিকে ঘুরলেই ওদের স্কুল।
কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ের ফাঁকা রাস্তা পেয়ে গাড়ির স্পীড কিছুটা বাড়িয়ে দিয়ে অর্ক বললো, “তা ছাড়া আমাদের সময়ের ক্লাস সেভেনের অঙ্ক বই পাবি কই? আরে বুঝতে পারছিস না? এই জমিটা খুব তাড়াতাড়ি হাত বদল হয়ে যাবে। পার্টি পয়সা নিয়ে কাউকে না কাউকে বেঁচেই দেবে। পাঠকবাবু যা লুকিয়েছেন সেটা তার আগেই খুঁজে বার করতে হবে। জিনিসটা এতদিন ধরে খোঁজার দরকার পরেনি, এখন উপায় না দেখে উনি আমাদের স্বপ্নে এসে ওটার খোঁজ দিয়ে গেছেন।”
“তুই তাহলে শিওর যে অঙ্কটাই সুত্র?”
“টু হান্ড্রেড পার্সেন্ট! দেখ তোর অঙ্ক না পারাটা কোন স্বাভাবিক ঘটনা না। আর আমার স্বপ্নে এসে পাঠকবাবু ক্লিয়ার বলেছে সুত্র তুইই জানিস, তাই এটা অঙ্ক ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না।” অর্ক বেশ জোর দিয়েই বললো।
“কিন্তু সিলেবাস তো অনেক চেঞ্জ হয়েছে, আমাদের সময়ের পাঠ্য বইয়ের অঙ্ক নাকি এইসময়ের পাঠ্য বইয়ের অঙ্ক সেটা কিভাবে বুঝবি?” শুভেন্দু কিছুতেই জিনিসটা মন থেকে মেনে নিতে পারছে না।
“যতদূর মনে হয় আমাদের সময়েরই বই হবে। কারণ, তুইই তো বললি যে মানুষ যেটা আগে দেখেনি সেটা স্বপ্নে আসতে পারে না। তুই নিশ্চয়ই ইদানিং কালের অঙ্ক বই দেখিসনি তাই না? তাই আমাদের সময়েরই অঙ্ক বইতে ব্যাপারটা থাকবে। আর আমার স্বপ্নেও যে জায়গাটা দেখেছিলাম সেটাও তো ইদানিং কালের নয়। বর্তমান সময়ে কত পরিবর্তন হয়েছে দেখছিস তো?”
“কিন্তু স্কুলে কি ওতো পুরোনো বই পাবো?” শুভেন্দু একটু সময় নিয়ে কথাগুলো বললো।
“সেটা আমিও ভেবেছি, তবে লাইব্রেরিতে থাকতে পারে আশা করি। না পেলে কলেজ স্ট্রিট যেতে হবে, কারণ তুই তো ভুলেই মেরে দিয়েছিস কি অঙ্ক ছিল।” শুভেন্দুর দিকে একটা মুখ বাঁকানো হাসি হেসে বললো অর্ক।
“আরে ভাই, ওটা একটা স্বপ্ন ছিল রে। আমি কিন্তু এখনো জানি না আমরা আলেয়ার পিছনে দৌড়াচ্ছিস কিনা।”
“না রে, আলেয়া না। আছে আছে, ওখানে কিছু তো আছে। এত জ্যান্ত স্বপ্ন আমি জীবনেও দেখিনি।”
শুভেন্দু আর কথা বললো না, কারণ ও জানে অর্কর কথা একশো শতাংশ ঠিক।
জোনপুর মোড় থেকে ওদের গাড়িটা বাঁ দিকে বেঁকে কাঁপা মোড়ের সিগন্যালে এসে দাঁড়ালো।
“আচ্ছা কি ধরনের গুপ্তধন থাকতে পারে বলে তোর মনে হচ্ছে?” শুভেন্দু প্রশ্ন করলো।
“সোনাদানা হবে না বলেই মনে হচ্ছে, কোনো নকশা হতে পারে কি? ধর গুপ্তধনের নকশা?”
“এটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না? আচ্ছা, তুই লোকটাকে পার্টি অফিস করে দিবি বলে যে প্রতিশ্রুতি দিলি সেটা লোকটাকে হাতে রাখার জন্যই তো?” শুভেন্দু বললো।
“তাছাড়া আবার কি? না আমি ঐ জমি কিনবো, না ওখানে পার্টি অফিস বানাবো। আসলে ঐ প্রতিশ্রুতিটা না দিলে ওরা অন্য খদ্দের ধরে নিত। এই তো স্কুল চলে এসেছে, চল।”
“কত বছর পরে ঢুকবো স্কুলে, ভাবতেই কেমন লাগছে।” আনন্দে শুভেন্দুর চোখে জল চলে এলো।
বহুদিন পরে স্কুলে ঢুকে ওরা বেশ নস্টালজিক হয়ে পড়লো। এখন যিনি সহকারী প্রধান শিক্ষক, যাকে স্কুলে পড়ার সময় ওরা যমের মতন ভয় পেত, তিনিই ওদেরকে সাদরে আপ্যায়ন করলেন। নিজের চেম্বারে বেশ কিছুক্ষণ বসিয়ে জমিয়ে গল্প করলেন। স্যারের মুখেই ওরা জানতে পারলো পাঠকবাবুর মৃত্যুর পরে এখন ওর পরিবারের খুব অবস্থা খারাপ। পাঠকবাবুর চলে যাওয়ার বেশ কিছুদিন পরেই উনার স্ত্রী গত হন, ব্যাস পেনশনের ওখানেই ইতি। যে বাড়িতে থাকতেন সেই বাড়ি বিক্রি করে ছেলেটা একটা পাড়ার ক্লাবের আশ্রয়ে থাকে। ব্যাপারটা শুনে দুজনেরই মন খারাপ হয়ে গেল।
এ কথা, সে কথার পর অর্কই ক্লাস সেভেনের বইয়ের প্রসঙ্গটা তুললো।
“ক্লাস সেভেনের অঙ্ক বই, তাও আবার তোদের সময়ের, মাঝে একবার সিলেবাস চেঞ্জ হয়েছে, দুহাজার এগারো বারো সাল নাগাদ। ঐ বই দিয়ে কি করবি তোরা?” সহকারী প্রধান শিক্ষক বাসুবাবু প্রশ্ন করলেন।
“আসলে, হয়েছে কি,” শুভেন্দু বললো, “আমার কাছে একটা ছেলে রিসার্চ করতে এসেছে, যে সিলেবাসে অঙ্কের পরিবর্তন নিয়ে একটা থিসিস লিখতে চায়। স্বাধীনতার পর থেকে স্কুল লেভেলে অঙ্কের সিলেবাস কিভাবে বদলে গেছে ওটাই ওর রিসার্চের বিষয়।”
বানিয়ে বানিয়ে বললো শুভেন্দু। ওরা গাড়িতেই আলোচনা করে নিয়েছিল স্কুলে গিয়ে ব্যাপারটাকে কিভাবে বলবে।
“ঠিক আছে! লাইব্রেরীতে গিয়ে খুঁজে দেখতে পারিস, জানি না পাবি কিনা।” বলে বাসুবাবু ওদেরকে স্কুলের লাইব্রেরীতে নিয়ে গেল।
প্রায় আধঘণ্টা খোঁজার পরে অর্ক বেশ উত্তেজিত হয়ে চিল্লিয়ে উঠলো, “এই তো পেয়েছি, এই দেখ।”
দুজনে তাড়াতাড়ি বাঁধাই আলগা হয়ে যাওয়া ওদের সময়ের পুরোনো বইটাকে সেন্টার টেবিলের উপর নিয়ে এলো।
“কত নম্বর চ্যাপ্টারের কত নম্বর অঙ্ক ছিলো সেটা মনে আছে তো?” অর্ক প্রশ্ন করলো শুভেন্দুকে।
“হ্যাঁ, সাত নম্বর অধ্যায়ের তেইশ নম্বর অঙ্ক। এই তো সাত নম্বর অধ্যায়, কিন্তু এটা কি?” শুভেন্দু হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো বইটার দিকে।
“দেখি দেখি,” বলে বইটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে অর্কও একটু হোঁচট খেলো।
সাত নম্বর অধ্যায়ে মোট অঙ্ক মাত্র বারোটা।
“তুই ঠিক করে মনে কর তো, তেইশই বলেছিলেন কি স্যার?”
“আমার একটা জিনিস এখন মনে হচ্ছে জানিস?” শুভেন্দু একটু ভেবে নিয়ে অর্ককে বললো।
“কি?”
“আরে, আমি কিন্তু স্কুল আমাদের পরের সময়ের অঙ্ক বইগুলোকেও দেখেছি। আসলে আমার ভাই আমাদের তিন ক্লাস নিচে পড়তো, আমিই ওকে অঙ্ক করাতাম। তারপর তো কলেজে উঠে দেদার টিউশনি করিয়েছি। আমি কিন্তু নতুন সিলেবাসের বইও দেখেছি।”
“তার মানে দুহাজার বারোর পরের বইটা খুঁজে দেখা যেতে পারে, তাই তো? ওটা তো রানিং সিলেবাসের বই, এখানেই পেয়ে যাবো।” কথাটা বলে শুভেন্দুর উত্তরের অপেক্ষা না করেই অর্ক আবার খোঁজাখুঁজি আরম্ভ করে দিলো আর কিছুক্ষণের মধ্যে বইটা পেয়েও গেলো।
“এই দ্যাখ!” অর্ক বইটাকে শুভেন্দুর হাতে দিয়ে বললো, “এইটা হলো আমাদের পরের সিলেবাসের বই। এবার এর সাত নম্বর অধ্যায়ের তেইশ নম্বর অঙ্কটা দেখা যাক।”
ওরা উত্তেজনায় লাফাতে লাফাতে ওরা বইটা খুললো, কিন্তু এবারও হতাশ হলো। বইতে এমন কোনো অঙ্ক ওরা পেলো না যার সাথে গুপ্তধনের নিশানার সামান্যতম নির্দেশ থাকতে পারে।
“এ ভাই!” অর্ক শুভেন্দুকে বললো, “ক্লাস সেভেনই ছিলো তো? মানে তোর স্বপ্নে অনুযায়ী আমরা তখন ক্লাস সেভেনেই পড়ি তো? দ্যাখ, অন্য কোনো ক্লাস হলে কিন্তু অন্য বই খুঁজতে হবে।”
“হ্যাঁ রে, আমরা সেভেনেই পড়তাম। করিডোরের শেষ ক্লাসরুমটায় পড়তাম, আমি ওটাই স্বপ্নে দেখেছি।”
“বেশ! ক্লাস সেভেন মেনে নিলাম। কিন্তু অঙ্কটা পাচ্ছি না কেন? নম্বরটা ঠিক তো? আরেকবার নিজের স্মৃতিতে জোর দিয়ে দ্যাখ না!”
“আরে হ্যাঁ রে, তেইশই বলেছিলেন। আমার খুব স্পষ্ট মনে আছে, এতটাই জীবন্ত ব্যাপারটা যে....” বলতে বলতে হটাৎ করেই থেমে গেলো শুভেন্দু।
“কি হলো, বল, কি স্পষ্ট মনে আছে?” অর্ক অধৈর্য হয়ে উঠলো।
“আরে তোর মনে আছে, তোকে বলছিলাম কি একটা কারণে আমি স্যারকে দেখে টেনশন নিয়ে নিয়েছিলাম, সেটা মনে পড়ছিল না?” শুভেন্দুর ঠোঁটের গোড়ায় যেন একটু হালকা হাসি দেখতে পেলো অর্ক।
“হ্যাঁ, বলেছিলিস তো। সেটা মনে পড়েছে নাকি?”
“হ্যাঁ পড়েছে। আমি সত্যিই বোকা হয়ে গেছি, এই বইটা স্যার ক্লাসে পড়াতেন না, তোর মনে নেই? স্যার একটা রেফারেন্স বই পড়াতেন, কারণ স্কুলের পাঠ্যবইয়ের অঙ্কগুলো নাকি খুব সোজা ছিল। সেভেনে যখন পড়ি, আমি তখন ঐ রেফারেন্স বইটা কিনতে পারিনি বেশ কিছুদিন। সবার কেনা হয়ে গেছিল, আমিই শুধু কিনিনি। আরে, সেই জন্যই তো পাঠকবাবুকে ক্লাসে ঢুকতে দেখে ওরকম টেনশনে পড়ে গেছিলাম।” বলে শুভেন্দু একটু বোকা বোকা হাসি দিলো।
“ও আচ্ছা, হ্যাঁ তাই তো। আমাদের তো পাঠ্য বই উনি পড়াতেনই না। এটা তো আমারও খেয়াল ছিল না। উনি তো পরীক্ষাতে ঐ বইটা থেকেই প্রশ্ন করতেন। তো এবার কি করবো? ঐ বইটা কোথায় পাবো? সেটা তো স্কুলের লাইব্রেরিতে সম্ভবত থাকবে না।” অর্কর স্বরে হতাশা ঝরে পড়লো।
“আরে, তুই চাপ নিচ্ছিস কেন? বইটা পাওয়া সমস্যাই না, কারণ বইটা আমার বাড়িতেই আছে!” বলে লাইব্রেরী থেকে বেরিয়ে এল শুভেন্দু।
অর্ক ওর পিছনে আসতে আসতে বললো, “বলিস কি? ওতো পুরোনো বই এখনো বাড়িতেই রেখে দিয়েছিস?”
“কারণ আছে বন্ধু।” শুভেন্দুর গলাটা একটু বাড়ি হয়ে এলো, “আসলে বইটা কিনতে পারিনি টাকা ছিল না বলে। মা খুব কষ্ট করে টাকা যোগাড় করে বইটা কিনে দিয়েছিল, সেই থেকে টাকা দিয়ে কেনা, কোনো বইই আমি জীবনে বিক্রি করিনি।”
অর্ক বুঝতে পারলো ব্যাপারটা, বছর দুয়েক আগে শুভেন্দুর মা গত হয়েছেন, শুভেন্দু এখনো শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি পুরোপুরি। অর্ক তাড়াতাড়ি শুভেন্দুর পিঠে হাত দিয়ে বললো, “তাহলে চল, যাওয়া যাক তোর বাড়ি।”
স্কুল থেকে বেরিয়ে শুভেন্দুর বাড়ি পৌঁছাতে দুজনের সময় লাগলো পনেরো মিনিট। বাড়ি পৌঁছেই দুজনে তাড়াতাড়ি চলে এলো লাইব্রেরী ঘরে। বইটা খুঁজে পেটে বিশেষ সময় লাগলো না, শুভেন্দুর প্রায় তিন হাজার বইয়ের বিশাল লাইব্রেরির পুরোটাই ক্যাটালগ করা।
বইয়ের নির্দিষ্ট পৃষ্ঠায় পৌঁছে এবার আবার হতাশ হতে হলো ওদের দুজনকেই। সাত নম্বর অধ্যায়ে তেইশ নম্বরে কোনো অঙ্কই নেই। কুড়ি নম্বরেই চ্যাপ্টার শেষ হয়ে গেছে। স্বপ্নে উল্টো শুনেছিল কিনা সেটা ভেবে তেইশ নম্বর অধ্যায়ের সাত নম্বর অঙ্ক খুঁজতে গিয়ে দেখতে পেলো যে বইটাতে মাত্র পনেরোটা অধ্যায় আছে।
“এবার!” শুভেন্দু অর্কর উদ্দেশ্যে হতাশ স্বরে বললো!
“দাঁড়া দাঁড়া ভেঙে পড়লে চলবে না আমাদের।” অর্ক বললো, “আমার মনে হয় আমাদের একটু টাইমলাইন নিয়ে ভাবা উচিত।”
“কিরকম?”
“দ্যাখ, এটা দুহাজার বাইশ চলছে, আমরা মাধ্যমিক দিয়েছি দুহাজার ছয়ে, তার মানে ক্লাস সেভেনে যখন পড়ি সেটা দুহাজার দুই সাল। পাঠকবাবু রিটায়ার করেন আমরা যখন নাইনে মানে দুহাজার চার সালে। উনি মারা যান দুহাজার পনেরোতে। তোর কাছে যে রেফারেন্স বইটা আছে, সেটা আমাদের সময়ের। এর পরের সময়ের রেফারেন্স বইগুলোও তুই দেখেছিস, কিন্তু তোর স্বপ্নে অঙ্কটা কিন্তু আসেনি। তার মানে অঙ্কটাকে তুই জীবনেও দেখিসনি। তাহলে একটাই জিনিস হতে পারে সেটা হলো বইটা আমাদের আগের সিলেবাসের!”
“না রে!” শুভেন্দু হঠাৎ করেই উত্তেজিত হয়ে বললো, “নতুন সিলেবাসের রেফারেন্স বইটা আমি দেখিনি। কারণ, পাঠকবাবু দুহাজার পাঁচে রিটায়ার করার পর তো এই রেফারেন্স বইটাকে আর কেউ রেফার করতো না। আমিও যখন পড়াতাম আমিও অন্য বই দেখে পড়াতাম, নতুন সিলেবাসের এই রেফারেন্স অঙ্ক বইটাকে আমি দেখিইনি।”
“তাহলে তো সেই বইটাকে দরকার আমাদের। আমার মনে হয় কোনো না কোনো বুক স্টোরে পেয়েই যাবো।”
এলাকার সমস্ত বইয়ের দোকানের সাথে শুভেন্দুর পরিচিতি আছে, ও ফোন বার করে দোকানগুলোতে ফোন লাগালো। কিন্তু পাঠকবাবু যে রেফারেন্স বই থেকে পড়াতেন, বর্তমান সিলেবাসের সেই রেফারেন্স বই এলাকার কোনো দোকানই রাখে না। অগত্যা পাবলিশার্সের ফোন নম্বর যোগাড় করে ফোন করা হলো। পাবলিশার্স ওদের পরিচয় পেয়ে বর্তমান বইটার সাত নম্বর অধ্যায়ের তেইশ নম্বর অঙ্কটা যে পাতায় আছে তার ছবিটা হোটসএপে পাঠিয়ে দিলো শুভেন্দুকে। ওদের স্কুলের পরিচয় পেয়ে প্রকাশক ভদ্রলোক আরো আরো একটা তথ্য দিলেন যে জীবদ্দশায় পাঠকবাবু নিজে এই বইটার এডিটর ছিলেন। অর্ক কথাটা শুনে শুভেন্দুর পুরোনো বইটার ভার্সো পাতাটা উল্টে দেখে দেখলো যে সেখানেও এডিটর হিসাবে কুলদারঞ্জন পাঠকের নাম জ্বলজ্বল করছে।
মোবাইলে সাত নম্বর অধ্যায়ের তেইশ নম্বর অঙ্কটা এবার আর হতাশ করলো না ওদের। অঙ্কটার দিকে দুজনেই নজর দিলো।
‘অগ্নিস্বর বাবুর দুই মেয়ে। বর্তমানে পূর্বার বয়স অগ্নিস্বর বাবুর তিনভাগের এক ভাগ। পূর্বা ওর দিদি উত্তরার থেকে ছয় বছরের ছোট। বর্তমানে তিনজনের বয়সের সমষ্টি এমন একটা সংখ্যা যা, তিনের দ্বিঘাতের দ্বিঘাত সমান। তিনজনের বয়স কত?’
“যা বাবা, এটা আবার কি সঙ্কেত?” অঙ্কটা অর্কর মাথার উপর দিয়ে গেলো।
এদিকে শুভেন্দু বেশ মন দিয়ে অঙ্কটা দেখেই যাচ্ছে। একটা ডায়েরি খুলে পেন দিয়ে তাড়াতাড়ি অঙ্কটা টুকে নিলো।
“এদিকে দেখ, অঙ্কটা কিন্তু মজার। তিনটে ব্যাক্তি আছে, অগ্নিস্বর, পূর্বা আর উত্তরা। আচ্ছা এগুলো এক একটা দিক না?”
অর্ক ডায়েরির পাতায় লেখা তিনটে নাম ভাল করে দেখলো, তারপর বললো, “সেরকম ভাবলে পূর্বা মানে পূর্ব, উত্তরা মানে উত্তর দিক হতে পারে। আর অগ্নিস্বর বলতে কি অগ্নিকোন মানে দক্ষিণ-পূর্ব কোন বোঝাচ্ছে?”
“দেখ, গুপ্তধনে দিক নির্দেশ থাকবেই, নইলে খুঁজবো কি করে? তাই আমার মনে হচ্ছে এই নামগুলো দিক নির্দেশই হবে। এবার অঙ্কটা করে ফেললে কোন দিকে কতটা যেতে হবে তার একটা নির্দেশ পাবো।” শুভেন্দু কথাটা বলেই ডায়েরিতে অঙ্কটা কষে নিলো। তারপর বললো, “এই দেখ, অগ্নিস্বর বাবুর বয়স এসেছে পয়তাল্লিশ বছর, পূর্বার পনেরো আর উত্তরার একুশ।”
“তার মানে, দক্ষিণ পূর্বে পয়তাল্লিশ যেতে হবে, তারপর পূর্বে পনেরো শেষে উত্তরে একুশ। কিন্তু সমস্যা হলো, ইউনিটটা কি হবে? মানে পা হিসেব করে যাবো না ফুট হিসেব করে যাবো নাকি মিটার হিসেব করে যাবো? আরো একটা জিনিস শুরু করবো কোথা থেকে?” অর্ক গভীর ভ্রুকুটি নিয়ে প্রশ্ন করলো শুভেন্দুকে।
“আচ্ছা, এখানে তিনের দ্বিঘাতের দ্বিঘাত মানে একাশি সংখ্যাটার কোনো সিগনিফিকেন্স আছে কি?” নিজের করা সমাধানটার দিকে তাকিয়ে থেকেই কথাটা বললো শুভেন্দু।
“কি জানি ভাই, তবে এই অঙ্কে এর থেকে বেশি সুত্র নেই। শোন না, আমি বলি কি, একবার ঐখানে গেলে হয় না? জায়গাটা আবার একবার দেখতে হবে।” অর্ক গাড়ির চাবিটা হাতে নিয়ে বললো।
“সে, যেতেই তো হবে, চল, লাঞ্চ করে ওখানেই যাই।” শুভেন্দু অর্কর কথাতে সন্মতি প্রকাশ করলো।
কাঁচরাপাড়ার একটা রেষ্টুরেন্টে খেয়ে ওরা যখন আবার ঐ প্লটে এসে উপস্থিত হলো তখন বিকেল হয়ে গেছে। পার্টি অফিস বন্ধ। দুজনে ভাল করে দেখে বোঝার চেষ্টা করছে আদেও এমন কোনো জিনিস আছে কিনা যা একাশির সাথে মিল খায়।
কিন্তু সাধারণ বুদ্ধিতে এমন কিছুই পেলো না যা একাশি বা নয় বা তিনের সাথে মিল খাবে। অর্ক নিজের স্বপ্নটাকে আবার মনে করার চেষ্টা করলো। ওর স্বপ্নে উত্তরে একটাই বাড়ি ছিল, এখন তো পশ্চিমে রাস্তাটা বাদ দিলে সব জায়গাতেই বাড়ি।
এমন সময় ওদের সামনে এসে দাঁড়ালো একটা বাইক। অনলাইন ডেলিভারীর এজেন্ট।
“স্যার, সুরভী জানার বাড়িটা কোথায় বলতে পারবেন?” ওদের লোকাল ভেবে ছেলেটা প্রশ্নটা করলো।
“আমরা এদিকে থাকিনা ভাই।” অর্কই উত্তর দিলো।
“তাহলে স্যার, একাশি নম্বর বাড়িটা কোথায় বলতে পারবেন কি?” ছেলেটা আবারও প্রশ্ন করলো।
“না ভাই, আমরা জানি না…” বলেই ভূত দেখার মতন চমকে গেল অর্ক, ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, “কত বললে? একাশি?”
“হ্যাঁ, একাশি নম্বর কুলিয়া রোড।” ছেলেটা মোবাইলে আবার ঠিকানাটা দেখে নিয়ে বললো।
“দেখো তো, ঐ বাড়িটা কিনা?” নিজের স্বপ্নে দেখা একমাত্র বাড়ীটাকে দেখিয়ে বললো অর্ক।
ছেলেটা বাইক স্টার্ট দিয়ে চলে গেল। অর্কর আন্দাজই ঠিক। একটা অল্প বয়সী মেয়ে এসে ছেলেটার হাত থেকে পার্সেল নিয়ে গেল।
“ভাই শুভেন্দু, একাশি পেয়ে গেছি।” অর্ক চাপা গলায় বললো।
“জানি দেখেছি। তোর আন্দাজ করার ক্ষমতা দুর্দান্ত। আমাকে বলতেই হবে। তাহলে তো হয়েই গেল, ওখান থেকে অগ্নি কোন ধরে এগোলেই হবে। কিন্তু একক কি হবে? পা, ফুট না মিটার।”
“মিটার তো হবেই না, গোটা জায়গাটা পঞ্চাশ মিটারের থেকেও ছোট, হলে ফুট না হলে পা।” অর্ক বললো।
“তাহলে চল, মাপা যাক। পা হিসাবে তুই মাপ, আমি ফুট হিসাবে মাপছি।” শুভেন্দু বললো।
“মাপার যন্ত্র ছাড়া কিভাবে মাপবি এক ফুট কতটা?” অর্ক বললো।
“আমি একটা ট্রিক জানি। আমার হাইট হলো পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি। এর চার ভাগের এক ভাগ হলো, সতেরো ইঞ্চি। এই সতেরো ইঞ্চি হলো আমার কনুই থেকে মধ্যমার মাপ। এই মাপে একটা ডাল ভেঙে নেব। কিছুটা কম বেশি হবে ঠিকই, তবে কাজ চলে যাবে।” শুভেন্দু বললো।
“বাঃ, এরকম ভাবে মাপা যায়, জানতাম না তো।” অর্ক বললো, “চল তাহলে শুরু করি।”
দুজনের মাপ দুটো আলাদা জায়গায় গিয়ে শেষ হলো। ওরা সিদ্ধান্ত নিলো দুটো জায়গাই খোঁড়া হবে। বিকেলের শেষ সূর্য তখন লাল আভা ছড়াচ্ছে দিগন্তের কাছে। অর্ক নিজের কনসালটেন্সি ফার্ম থেকে কিছু লোক ডেকে আনলো মাটি খোঁড়ার জন্য।
দুটো জায়গায় প্রায় চারফুট খুঁড়ে একটাতে পাওয়া গেল একটা লোহার সিন্দুক। সেটা খুলে উদ্ধার হলো একটা কাগজ।
রাস্তার আলোতে অর্কর গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে দুজনে কাগজটা খুললো।
“আরে এটা তো একটা দলিল মনে হচ্ছে রে!” অর্ক বললো।
“হ্যাঁ, দলিলই। এই তো লেখা আছে, আশি নম্বর, কুলিয়া পাঠ রোডের এই জমিটা সুনীল পাঠককে হস্তান্তর করা হলো। নিচে সই করেছেন সুকুমার সোম।” দলিলের শুরুটা পড়ে বললো শুভেন্দু।
“আরে, সুকুমার সোমের ব্যাপারে বলেছিল না, ঐ পার্টি অফিসের লোকটা? মরে ভূত হয়ে গেছে।”
“ঠিক তাই, এবার তাহলে বোঝা যাচ্ছে যে, সুকুমার সোম এই জমিটা পাঠকবাবুকে দিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু সেটা কেন দিয়েছিলেন সেটা লেখা নেই। কোনো কারণে স্যার সেটা এটা লুকিয়ে রেখেছিলেন। সেই কারণটা আমরা হয়তো জানতে পারবো না, কিন্তু এই দলিলটা উনার ছেলের হাতে পৌঁছে দেওয়া আমাদের কর্তব্য।” শুভেন্দু বললো।
“হ্যাঁ! জমিটার কিছুটা অংশ বিক্রি করে দিয়ে ওর ছেলে এখানে একটা ছোট বাড়ি করে মনে হয় থেকে যেতে পারবে।” অর্ক গাড়িতে উঠতে উঠতে বললো।
দলিলটা সেই রাতেই ওরা পৌঁছে দিয়েছিল পাঠকবাবুর ছেলেকে। রাতে দুজনের স্বপ্নেই পাঠকবাবু এসে ওদের একটা করে লজেঞ্চুস খাইয়ে গেছেন।