চরম অশান্তির পরে রূপম বাড়ি থেকে টোটো নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পরে সদর দরজা বন্ধ করে ঘরে এসে পরে থাকা ভালো নাইটিটা খুলে একটা রংচটা নাইটি পরে নিলো পম্পা। তারপর পুরোনো গোয়াল ঘরটা খুলে আলো জ্বালিয়ে দিলো। একে একে রিং লাইট, লাল ডিম লাইট অন করে মোবাইলটা হোল্ডারে সেট করে দিলো। মুডটা খিঁচড়ে থাকলেও কাজ তো করতেই হবে তাই, ফ্রন্ট ক্যামেরা অন করে রেকর্ডিং শুরু করলো পম্পা...
‘প্রেম করতে জানতে হয়.. হাত ধরে রাখতে জানতে হয়.. ছেড়ে দিলেই ছেড়ে যাওয়া যায়.. কিন্তু বালাই ষাট! ছাড়বো কেন?
তোমরা তো জানোই বন্ধুরা, আগের পনেরোটা এপিসোডে আমি তোমাদের বলেছিলাম কিভাবে শুধুমাত্র ভালোবাসার টানে সব বাধা প্রতিকূলতা পেরিয়ে আমি আর রূপম আজও একসাথে সুন্দরভাবে সংসার করছি। আজ একটু আগে কাজে বেরোনোর সময় রূপম আমাকে প্রমিস করে গেছে একটা পার্লের কানের দুল নিয়ে আসবে। তোমরা তো জানোই, ও আমাকে কি সব গিফট এনে দেয়! কতবার বলেছিলাম আমার আইফোন লাগবে না, কিন্তু সেই এনেই দিলো আগের মাসে। সেটা তো তোমাদের দেখিয়েছিই। আর আজ আমি দারুন খুশি, তাই আরেকটা এপিসোড শুরু করতে চলেছি আমি, কিভাবে অতি অল্প ইনকামে শুধুমাত্র ভালোবাসার মানুষটার হাত ধরে আপনিও একটা সুখী গৃহকোণ তৈরি করতে পারবেন।’
হঠাৎ করে বেজে ওঠা কলিং বেলের শব্দটাতে একটু চমকে উঠলো পম্পা আর তাতেই রেকর্ডিংটাতে একটু ছেদ পড়লো।
আরেকবার বাজলে উঠে পড়তে হলো পম্পাকে, একটা ওড়না জড়িয়ে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বাড়ির মেন গেটের কাছে গিয়ে প্রশ্ন করলো, “কে?”
“দিদি বাড়ি আছেন?” একটা মেয়ের গলা শোনা গেল গেটের ওপাশ থেকে।
“কোন দিদি?” প্রশ্নটা করে পম্পার মনে হলো বোকামি করে ফেলেছে, কারণ এই বাড়িতে মেয়ে বলতে ও একাই।
“এটা পম্পা সামন্তর বাড়ি তো?”
এবার দরজা খুলে দিলো পম্পা, একটা অল্পবয়সী মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে গেটের ওপারে। মেয়েটাকে দেখে চেনা চেনা লাগলেও মনে এলো না কোথায় দেখেছে। একটা সুন্দর লাল আর বেগুনি ডোরাকাটা চুড়িদার পরে আছে মেয়েটা, সিঁথিতে জ্বলজ্বল করছে বেশ খানিকটা লাল সিঁদুর আর হাতে একগাছা চুড়ি। পম্পার মনে হলো একদম নব-বিবাহিতা একজন বাচ্চা মেয়ে ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
“যাক! তাহলে ঠিক জায়গাতে এসেছি।” গেট খোলার পরে সামনে দাঁড়ানো পম্পাকে দেখে নিজেকেই যেন কথাটা বললো মেয়েটা। তারপর পম্পাকে কিছু না বলেই তরতর করে বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়লো।
মেয়েটাকে এইভাবে ঢুকতে দেখে একটু হকচকিয়ে গেল পম্পা, কি বলবে বুঝে উঠতে পারলো না, গেটের সামনে দাঁড়িয়েই দেখলো মেয়েটা একটা ফোন বার করে পটাপট ছবি তুলতে শুরু করে দিলো বাড়ির ভিতরটার।
“এই এই এই, কি করছো তুমি? তুমি কে? কি চাও?” প্রায় চিল্লিয়ে উঠলো পম্পা।
“ওহ! দিদি আমি তোমার খুব বড় ফ্যান! আমি নাম সৌমী নিয়োগী। ওহ! জীবনে প্রথমবার কোনো সেলিব্রেটির বাড়ি এলাম। কি যে ভালো লাগছে না দিদি, উফফ! বলে বোঝাতে পারবো না।” আগন্তুক মেয়েটা যেন উড়ছে এমন ভাবে নাচতে নাচতে কথাগুলো বললো।
ব্যাপারটা পুরোপুরি না বুঝলেও কিছুটা বুঝতে পেরেছে পম্পা। এই মুহূর্তে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামে মোটামুটি ভালোই ফলোয়ার্স হয়েছে ওর। ওর লাইফস্টাইল ভ্লগগুলো বেশ জনপ্রিয় দুটো সাইটেই। এই মেয়েটা মনে হয় ওরকমই কোনো একজন ফলোয়ার, বাড়ি খুঁজে দেখা করতে চলে এসেছে। ব্যাপারটা ভেবেই খুব আনন্দ পেলো পম্পা। এরকম যে হবে, ওর বাড়ির সামনেও যে ফ্যানেদের আনাগোনা হবে, ছোট্ট শহরে ওকে একডাকে লোকে চিনবে এটা ও সবসময়ই চেয়ে এসেছে । তবে এত তাড়াতাড়ি সেটা বাস্তবায়িত হয়ে যাবে সেটা বুঝতে পারেনি।
“আচ্ছা আচ্ছা! তুমি তাহলে সৌমী? আসো আসো ঘরে আসো। বাড়ি চিনলে কি করে?”
সৌমী ফোনটা ব্যাগে ঢুকিয়ে বললো, “আর বলো না, সে অনেক কথা। কত যে খুঁজেছি তোমায়…” তারপর একটু বিষন্ন গলায় বললো, “ভেবেছিলাম পাবোই না।” কথা শেষ করে ব্যাগ থেকে একটা কোল্ড ড্রিংকের বোতল বার করে পম্পার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো, “মিষ্টি আনিনি, এটাই নিয়ে এলাম।”
বোতলটা হাতে নিয়ে যেন শক খেলো পম্পা, এত ঠান্ডা বোতল শুধু নয়, এত ঠান্ডা কোনো জিনিসই ও হাতে নেয়নি জীবনে কখনো। মনে হলো ডিপ ফ্রিজ থেকে জাস্ট বোতলটা বার করে ওর হাতে দিয়েছে সৌমী।
তবে ব্যাপারটাকে আমল দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলো না ও, কারণ তখন ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে ওর ওর এক ফ্যান, তাও আবার সশরীরে। ইনবক্সের চ্যাটে ‘দিদি তুমি সুপারহিরো’ বলা কোনো মেয়ে নয়, কোনো পোস্টের কমেন্টে ‘বোন তুমিই আদর্শ’ বলা কোনো গৃহবধূ নয়, বরং কোল্ড ড্রিংক্স নিয়ে বাড়ি খুঁজে দেখা করতে আসা একজন রক্ত মাংসের মানুষ।
সদর দরজা বন্ধ করে সৌমীকে নিয়ে বারান্দায় বসালো পম্পা। ওদের বাড়িটার দুটো পার্ট। সরকারি অনুদান পাওয়া একটা আড়াই লাখের দু কামরার বাড়ি, আর তার পাশে টিনের ঘেরা, টিনের ছাদ দেওয়া একটা ঘর। পম্পার শ্বশুরবাড়িতে বর ছাড়া কেউ নেই। ওর বর টোটো চালায়, পম্পা ঐ টোটো করেই পড়তে যেত আর টোটোতে যেতে যেতেই ভাব ভালোবাসা, শেষে এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে মন্দিরে বিয়ে। পম্পা গৃহবধুর সাথে সাথে এখন সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সর, লাইফ স্টাইল ভ্লগার।
“কি খাবে তুমি?” সৌমীর মুখোমুখি বসে প্রশ্ন করলো পম্পা।
“না দিদি, কিছুই খাবো না। তোমার সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যেই আমার আসা। আসার সময় আমি খেয়েই এসেছি। তুমি ব্যস্ত হয়ো না, আমি তোমার সাথে একটু কথা বলেই চলে যাবো।”
“আরে তা হয় নাকি। এই দুপুরে দিদির বাড়ি এসেছো, আমি একটু চা করে আনি?”
চায়ের কথা শুনেই কেমন যেন বদলে গেল মেয়েটা। সৌমীর সুন্দর মুখটা যেন অজস্র বলীরেখায় ভরে গেল মুহূর্তের মধ্যে। পম্পার মনে হলো কোনো সদ্য বিবাহিত হাসিখুশি কেউ না, যেন নিশ্বাস আটকে থাকা প্রচন্ড কষ্ট পাওয়া একটা মানুষ ওর সামনে বসে আছে!
ভয় পেয়ে আঁতকে উঠলো পম্পা। চিত্কার করতে যাবে এমন সময় বুঝতে পারলো পুরোটাই ওর মনের ভুল। কারণ সামনেই বসে আছে অল্পবয়সী সৌমী, যেমনটা দেখতে ছিল ঠিক তেমনটাই। যেন এইমাত্র মেয়েটা বাসর ছেড়ে উঠেছে এরকমই একটা স্নিগ্ধ হাসি নিয়ে পম্পার দিকে তাকিয়ে আছে সৌমী।
হঠাৎ করেই যেন মাথাটা একটু ঘুরে গেল পম্পার। প্রেসার ফল করলো কিনা বুঝতে পারলো না, যেখানে বসে ছিলো সেখানেই বসে রইলো।
“দিদি! তুমি এরকম করছো কেন? তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?” সৌমী যেন ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে, টেবিলে রাখা একটা বোতল এগিয়ে দিলো পম্পার হাতে।
সৌমীর দিকে না তাকিয়েই পম্পা বোতল খুলে জল গলায় ঢেলে দিলো, আর তার সাথে সাথেই মুখে নেওয়া পুরো জলটাই ওয়াক করে মুখ থেকে বার করে দিলো।
“কি হলো দিদি?” আবার ব্যস্ত হয়ে উঠলো সৌমী।
পম্পা বোতলটা সৌমীর দিকে এগিয়ে ধরে চোখ মুখ কুঁচকে জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে নিতে বললো, “গরম!... খেয়ে দেখো... মনে হচ্ছে... উফফ কি গরম জল.. মনে হচ্ছে.. এই জল কখন ভরলাম আমি? এতো ফুটন্ত জল... উফফ আমার মুখ পুড়ে গেল। গলা বুক জ্বালা ধরে... উফফ..”
“বলো কি?” বোতলটার দিকে দেখে ওটা থেকেই এক ঢোক জল খেয়ে সৌমী বললো, “কি যে বলোনা দিদি, এতো ঠান্ডা জল। এই গরমে এরকম ঠান্ডা জলই তো লোকে খায়। অবশ্য এর থেকে বেশি ঠান্ডা খেলে আমার আবার গলা ধরে যায়। তুমি এটাকে গরম বলছো?”
হঠাৎ করেই যেন পম্পার শরীরটা খারাপ লাগতে শুরু করেছে, একটা অস্বস্তি হচ্ছে, সৌমীর হাতে ধরে থাকা বোতলটা যেন ওকে ডাকছে, সৌমীর বলা কথাটা যেন পম্পার তেষ্টা আরো বাড়িয়ে তুললো। সৌমীর হাত থেকে আবারও বোতলটা নিয়ে জল খেতে শুরু করলো। কিন্তু এবার আর গরম লাগলো না, তার বদলে পম্পার গলা দিয়ে পেটের ভিতরের দিকে নেমে গেল বরফ শীতল একটা জলের ধারা। অনেকদিন আগে পাড়াতে একটা সাপুড়ে এসেছিল সাপের খেলা দেখাতে। পম্পা সাপটাকে ধরতে পেরেছিল একবার। সেই ঠান্ডা শরীর ধরার অনুভূতি যেন ফিরে এলো আবার।
তবে জলটা যেন ওষুধের কাজ করলো, পম্পার ধড়ে প্রাণ ফিরিয়ে আনলো। তড়াক করে উঠে দাঁড়ালো পম্পা, সৌমীকে বসতে বলে নিজের ফোনটা হতে নিয়ে শোওয়ার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো।
খাটে বসে পম্পা বোঝার চেষ্টা করলো ওর সাথে কি কি হলো এই কিছুক্ষণের মধ্যে। একজন অচেনা মেয়ে ফ্যান হিসাবে দেখা করতে এসেছে বলেই কি ও আনন্দের চোটে এইসব ভুলভাল জিনিস দেখে ফেলছে? নিজেকে প্রশ্ন করেও উত্তর পেল না ও। মিনিট দুয়েক চুপ করে বসে থাকলো, তারপর কি একটা মনে হওয়াতে ফোন খুলে ফেসবুকে ঢুকে সার্চ বারে টাইপ করলো ‘সৌমী’।
শুরুতেই যে গোটা কুড়ি নাম এলো তাতে মেয়েটাকে পেল না পম্পা। সেটা অবশ্য স্বাভাবিক ঘটনা, কারণ সৌমীর পদবী দিয়ে সার্চ ও করেনি, আর সৌমী নামের মেয়ের প্রোফাইলও যে সৌমী নামেই থাকবে সেটা ভাবার ও কোনো কারণ ঘটেনি।
আরো দু তিন ভাবে সার্চ করার চেষ্টা করলো কিন্তু ঐ নামে কোনো প্রোফাইল খুঁজে পেল না। মেয়েটা হয়তো নিজের নাম ভুল বলেছে পম্পাকে, কিন্তু তার পিছনে কোনো কারণ না খুঁজে পেয়ে ব্যাপারটা আরো বিরক্ত করে তুললো পম্পাকে।
নাহ, মেয়েটা কেন এসেছে সেটা জানতেই হবে! ভাবা মাত্রই দরজা খুলে বেরিয়ে এল পম্পা। সৌমীকে যেরকম ভাবে বসে থাকতে দেখে গেছিলো, মেয়েটা তেমনভাবেই বসে আছে। পম্পাকে আসতে দেখে সৌমী উঠে দাঁড়ালো, বললো, “দিদি সব ঠিক তো? আমি তো চিন্তায় পড়ে গেছিলাম।”
“হ্যাঁ ঠিক আছি আমি। ঐ একটু ... যাই হোক, আবার বলো তো দেখি ভাই, দিদিকে দেখতে এলে কেন হঠাৎ?” দাঁড়িয়েই কথা শুরু করলো পম্পা।
“বাহ! আসবো না? তুমি আমার আইডল। তোমাকে দেখেই তো আমি জীবনের সবথেকে বড় সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলাম। বিশ্বাস করো দিদি, যদি তোমার ভিডিওগুলো না থাকতো, তাহলে আমার হয়তো এতদিনে অন্য জায়গায় বিয়ে হয়ে দু একটা বাচ্চা কাচ্চাও হয়ে যেত। আমার ও, মানে আমার বরের জন্য আমি অপেক্ষা করে থাকতে পেরেছি শুধুমাত্র তুমি সাহস দিয়েছো বলে। ভালোবাসার টানে এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেও যে সুখে থাকা যায় সেটা তুমি প্রমাণ করে দিয়েছো দিদি। আমি চিরকালের জন্য তোমার কাছে কৃতজ্ঞ।” একটানা কথাগুলো বলে সৌমী যেন আরো গদগদ হয়ে গেলো।
পম্পার মনের অবস্থাও অনেকটা পরিবর্তিত হয়ে গেছে কথাগুলো শুনে। যদিও পম্পার মেসেঞ্জারে যেসব ফ্যানেদের মেসেজ আসে, সৌমীর কথাগুলোও যেন সেগুলোরই কপি পেস্ট। তবুও সরাসরি সামনে দাঁড়িয়ে একজন মানুষের মুখ থেকে কথাগুলো শোনার মজাই আলাদা, পম্পার মন এখন সেই মজাটাই নিচ্ছে।
কথাবার্তায় ছেদ পড়লো পম্পার ইনকামিং কলের আওয়াজে। পৌলমি বলে একজনের নাম ভেসে উঠলো হোয়াটসএপ কলের নোটিফিকেশনে। সৌমীর থেকে একটু সরে এসে ফোনটা রিসিভ করলো, “বলো।”
“কি করছো?”
“এই তো ভিডিও শুট করছি।”
“ওহ! কি পরে আছো?”
“কেন?”
“কেন আবার কি? আমি ভিডিও কল করতাম।”
“একটু পরে করছি আমি।”
“কেন? এখন কি অন্য কারোর সাথে কলে আছো?”
“বাজে বকছো কেন? ভিডিওটা মাঝপথে পজ করে তোমার কল রিসিভ করলাম।”
“আচ্ছা? আজ এতো লেট করলে কেন ভিডিও বানাতে? তোমার তো এতক্ষণে রোজ ভিডিও বানানো হয়ে যায়। আজ কখন বেরিয়েছে রূপম?”
“আজকের কন্টেন্ট একটু বেশি টাইমের, তাই সময় লাগছে। আচ্ছা, শোনোনা, দশ মিনিট পরে করি? এরপর কন্টিনিউটি এরর হয়ে যাবে।”
“ওকে! তবে বেশিক্ষণ ওয়েট করিও না। আমি তোমাকে দেখেই ঘুমাতে যাবো।”
“বাই!” ফোনটা কেটে দিয়ে দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকালো পম্পা। লস এঙ্গেলসে এখন মাঝরাত, আর একজন প্রবাসী কিনা পম্পার নগ্ন শরীরের জন্য অপেক্ষা করছে! সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সৌমীর দিকে তাকিয়ে আর ভিডিও কলের পরে ব্যাংক একাউন্টে যে টাকাটা ঢুকবে সেই দুটোর কথা ভেবে মনে মনে বেশ পুলকিত হলো। যাক এতদিনে তাহলে সেলিব্রেটি হওয়া গেলো!
“সরি একটা পার্সোনাল কল এসে গেছিল। বলো এবার তোমার কথা!” ফোনটা রেখে হাসিমুখে সৌমীর সামনে এসে দাঁড়ালো পম্পা। সৌমীকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিদায় করতে হবে এখন, দশ মিনিটের বেশি হলে আবার কল এসে যাবে। ছেলেটা ভারতীয় হলেও আমেরিকায় থাকতে থাকতে সময়ের ব্যাপারে একটু বেশিই সচেতন।
“সেরকম কিছু না দিদি। আমিও এবার বেরোবো, তোমার রেস্ট নেওয়ার সময়ে এসে খামোখা বিরক্ত করলাম।” সৌমী ওঠার উপক্রম করলো।
“আরে না না সেরকম না। তবে তুমি প্রথমবার এসেছো যখন, আসো আমার স্টুডিও ঘরে। দেখে যাও তোমাদের পম্পাদি কোথায় বসে ভিডিও বানায়।” কথাটা শেষ করে পম্পা সৌমিকে ইশারায় ওর সাথে যেতে বললো।
টালির ছাদ দেওয়া ঘরটায় ঢুকে সৌমী কেমন যেন উদাস হয়ে গেল। সব কিছুর দিকে বিষন্ন দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো। পম্পা ওর নতুন কেনা রিং লাইটটা দেখাতে দেখাতে বললো, “এই দেখো, কালই এটার আনবক্সিং ভিডিও করেছি। তুমি তো দেখেছো এটা?”
“নাহ! দেখা হয়নি।” অন্যমনস্কভাবে উত্তর দিলো সৌমী। তারপর পম্পার দিকে ফিরে বললো, “আচ্ছা দিদি, একটা লাইভ করলে কেমন হয়? এই ধরো আমি তোমার একজন ফ্যান, তোমার বাড়ি খুঁজে চলে এসেছি, এটার উপর! ভেবে দেখো, ব্যাপারটা কিন্তু জমে যাবে।”
“হ্যাঁ, কিন্তু আজ আমি হয়তো আর সময় দিতে পারবো না সৌমী। আমাকে একটা কাজে বেরোতে হবে। তুমি কি কাল আসতে পারবে? তাহলে আমি স্ক্রিপ্টটাও রেডি করে রাখতাম”
“এবাবা! যাঃ! কাল আবার আমার হবে না। ইনফ্যাক্ট আমার হাতে আজকের দিনটাই আছে। বিকেল পাঁচটার পরে আমার আর সময় হবে না দিদি। তোমার আজকের কাজটা কাল করতে পারবে না?”
ঘড়ি দেখলো পম্পা, লস এঞ্জেলসে বসে থাকা ব্যাক্তি আর অপেক্ষা করবে বলে মনে হয় না। তবে সেসব নিয়ে পম্পা খুব একটা চাপ নেয়না। একবার যখন প্রাইভেট ভিডিও কলের দুনিয়ায় ঢুকেই গেছে তখন কাকের অভাব হবে না সেটা ও বুঝেই গেছে। আট থেকে আশি না হলেও বারো তেরো বছরের মেয়ে থেকে ষাট পয়ষট্টির বুড়িদেরও এখানে কদর আছে।
পম্পাকে এখন ভাবাচ্ছে সৌমীর অফারটা। ফ্যান এনগেজমেন্ট সোশ্যাল মিডিয়ার শিখরে ওঠার অন্যতম মজবুত পিলার। সৌমীর মতন অচেনা একজন ফ্যান বাড়ি খুঁজে দেখা করতে এসেছে, এটাকে ঠিক মতন বেচতে পারলে রিচ আর ফলোয়ার দুটোই পাওয়া যাবে।
“আচ্ছা, ঠিক আছে।” সৌমীর প্রস্তাবে রাজি হয়ে পম্পা বললো, “ইন্সটা লাইভ করি তাহলে, কেমন? আচ্ছা কিরকম ভাবে ব্যাপারটা করা যায় বলো তো? প্রশ্ন উত্তর টাইপের করা যেতে পারে?”
“হ্যাঁ!” সৌমী উত্সাহিত হয়ে বললো, “সেটাই বেস্ট হবে। এমন ভাবে তুমি শুরু করো যাতে করে বোঝা যায় আমার আসাটা তোমার কাছে সারপ্রাইজ। তারপর আমাকে একটু প্রশ্ন করো, আমি তোমাকে একটু প্রশ্ন করি। ব্যাস, মিনিট পনেরোর লাইভ হলেই জমে যাবে।”
“গুড আইডিয়া। আমি সেটআপটা রেডি করছি। দু মিনিট, ব্যাস।”
মিনিট দুয়েকের মধ্যেই পম্পা লাইভের সেটআপ রেডি করে ফেললো। হোল্ডারে দামী আইফোন লাগিয়ে ঘরের সব আলো জ্বালিয়ে দিলো। সৌমী অবাক হয়ে দেখলো, এতদিন পম্পার যে ঘরটাকে ওর মনে হয়েছে গরিবের বাড়ি, সেটা আসলে গরিবের বাড়ি বানিয়ে রাখা একটা সেটআপ। কারণ টালির খাঁজে খাঁজে রাখা দামী এলইডিগুলোকে বেশ বুদ্ধি করেই সেট করেছে পম্পা। ক্যামেরায় ওগুলো দেখা যায় না, কিন্তু ঠিক মতন জ্বালালে ভিডিওটা দিনের কোন সময়ে করা হচ্ছে সেটা বোঝার কোনো উপায় থাকে না।
কতটা বোকা ওর মতন ফলোয়াররা সেটা ভেবে মনে মনে হেসে নিলো সৌমী। দুদিন আগেও পম্পার একটা ভিডিও দেখার সময়ে মনে হয়েছিল কত কষ্টের মধ্যে মেয়েটা সংসার করছে! এক কাপড়ে একটা টালির চাল দেওয়া ঘরে উঠে এসেছে প্রেমিকের হাত ধরে। আর আজ?
“হ্যালো বন্ধুরা। আজ হঠাৎ করেই লাইভে আসতে হলো আমাকে!” প্রচন্ড উত্ফুল্ল হয়ে লাইভ শুরু করে দিয়েছে পম্পা, “কারণ আজ আমার জীবনের একটা রেড লেটার ডে। আমাকে যে এতো ভালোবাসো তোমরা সেটা আজ প্রমাণ করে দিয়েছো তোমরা। আমার সামনে আজ উপস্থিত আছে একজন অচেনা মানুষ। না ঠিক অচেনা বলা যায় না, ঠিক যেন শত জন্ম ধরে আমরা একজন আরেকজনকে চিনি। তাই না সৌমী?”
সৌমী এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল, ক্যামেরার ফ্রেমের বাইরে। আর পম্পা একটা ময়লা কাঁথা পাতা কাঠের তক্তা দেওয়া খাটের উপর বসে কথা বলছিলো।
পম্পার কথা শুনে ওর পাশে এসে বসল সৌমী।
“দেখা যাচ্ছে আমাদের দুজনকে? আর আমার কথা শোনা গেলে একটা লাইক দিও বন্ধুরা।” পম্পার কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই তিন চারটে লাইক ভেসে এলো স্ক্রিনে।
এবার সৌমী প্রথম কথা বললো, “নমস্কার দিদির বন্ধুরা। আমি সৌমী, দিদির একজন ফ্যান।”
“ফ্যান কেন বলছো ভাই? তুমি আমার বোনের মতন। দিদি বলে যখন ডেকেছো তখন আজ থেকে তুমি আমার বোন।”
সৌমী মিষ্টি হেসে মাথা নাড়ালো।
পম্পা বললো, “তোমরা বললে বিশ্বাস করবে কিনা জানি না, কিন্তু সৌমী শুধু আমার সাথে দেখা করবে বলেই আমার বাড়ি খুঁজে চলে এসেছে। আজ ওর সাথে দেখা হওয়ার আগে অবধিই আমি ওকে চিনতাম না। আর এই অল্প সময়েই মনে হচ্ছে সৌমী যেন আমার কত দিনের চেনা। তো সৌমী, এবার বলো তো ভাই, আমাকে দেখার এতো কি দরকার পড়লো?”
“আসলে আমার যে হাসবেন্ড তার সাথে আমার টিন বছরের সম্পর্ক ছিল। ও আসলে একটা গ্যারাজে কাজ করে, তাই আমার বাড়ি থেকে মেনে নিচ্ছিলো না। অনেক অশান্তি হতো আমাদের মধ্যে। তারপর আমি দিদির ভিডিও দেখা শুরু করলাম। অল্প আয়েও যে সংসার চালানো যায়, শুধু মাত্র ভালোবাসার মানুষটা পাশে থাকলে সেটা দিদির প্রত্যেকটা ভিডিওতে আমি দেখতাম আর আমার বাড়ির লোককে বোঝাতাম। শেষ অবধি বাবা মানেনি, কিন্তু আমিও আর পারছিলাম না। তাই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিই একদিন, আর সৌরভের সাথে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে নিই। পম্পাদি না থাকলে, বুঝতে পারছেন আপনারা, আমি এতটা সাহস পেতাম না।”
পম্পা একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল সৌমির দিকে, মেয়েটা ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে খুব কনফিডেন্স নিয়ে নিজের গল্প বলে যাচ্ছিলো। সৌমির বলা শেষ কথাটা শোনার পরে বেশ গর্বভরে লাইভের স্ক্রিনের দিকে তাকালো পম্পা। বেশ ভালই কমেন্ট আসছে দেখে সেগুলো পড়ার চেষ্টা করলো পম্পা, কিন্তু অদ্ভুতভাবে সব কমেন্টেই লোকজন এক কথাই বলে যাচ্ছে দেখে ও প্রচন্ড অবাক হয়ে গেল।
পম্পার লাইভে আসা সব দর্শক পম্পাকে একটা কথাই জানাচ্ছে যে, সৌমীকে দেখা যাচ্ছে না। দুটো কমেন্ট পেলো যেখানে দুজন দর্শক বলছে তারা সৌমীকে না দেখতে পেলেও শুনতে পারছে ওর গল্প।
“এই সৌমী, মনে হয় কোনো টেকনিক্যাল সমস্যা হচ্ছে,” পম্পা একটু চিন্তিত হয়ে বললো, “তোমাকে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু দেখা তো যাওয়া উচিত, যেখানে তুমি বসে আছো সেটা তো ফ্রেমের মধ্যেই আছে!”
“শোনা তো যাচ্ছে তাই না?” সৌমী পম্পার দিকে না তাকিয়ে স্ক্রিনে কমেন্ট পড়তে পড়তে বললো, “দেখা যাওয়ার দরকার নেই, লাইভটা তো তোমার। লোকে আমাকে শুনতে পেলেই হবে। আমার গল্পটা লোকের জানা জরুরী, আমি গুরুত্বপূর্ণ না।”
“মানে?” কথাটা বলে প্রচন্ড অবাক হয়ে পম্পা দেখলো সৌমীর পরণের কাপড় যেন বদলে যাচ্ছে। বেগুনি আর লালের ডিজাইন করা সালোয়ার চেঞ্জ হয়ে মাটির রঙ ধারণ করেছে। আর চোখের নিমিষেই সালোয়ারটা যেন বদলে গেল একটা হাউসকোটে।
পম্পার অবাক ভাবটা কেটে গেছে ততক্ষণে, তার বদলে মনে জাঁকিয়ে বসছে আতংক! আর তার প্রধান কারণ পরণের কাপড়ের সাথে সাথে সৌমির মুখের ভাবও ততক্ষণে বদলে গেছে।
“নিশ্চয়ই আমাকে এবার দেখতে পারছো দিদির বন্ধুরা। আমি আসলে এখন এরকমই দেখতে হয়ে গেছি!” বদলে যাওয়া সৌমী কথা বলতে শুরু করেছে আবার, “একটু আগে যখন আমার বিয়ের আগের জীবনের গল্প করছিলাম তখন নিশ্চয়ই আমাকে দেখতে পারছিলেন না আপনারা। আসলে দেখবেন কি করে? সেই মানুষটা তো আজ আর বেঁচে নেই, বুঝলেন!”
কথাটা শেষ করে সৌমী পম্পার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো, অবশ্য ঘাড় ঘুরলেও বাকি শরীর ঘুরল না। আতঙ্কে নিশ্বাস নিতে ভুলে গেল পম্পা, বিস্ফারিত চোখে দেখতে পেলো সৌমীর গলার কাছে একটা মোটা কালো দাগ, যেন ওই দাগের উপর সাবলীলভাবে ঘাড়টা ঘুরছে।
সৌমী বলে চললো, “বুঝলেন না তাই না? আসলে দিদির দেখানো প্রেমের জীবনের লোভে যখন বাড়ি থেকে পালাই তখনও বুঝতে পারিনি, বাড়ির নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে এইসব কল্পনার জীবনের সাথে বাস্তবের জীবনের পার্থক্য কতটা। পম্পাদি দেখিয়েছিল ও বরের আয়ের উপর এই এক কামরার ঘরে নিজের সংসার সাজিয়েছে। আমিও ভেবেছিলাম সেটাই করবো। কিন্তু জানতাম না যে, হাতির দেখানোর দাঁত আলাদা আর খাওয়ার দাঁত আলাদা। আপনারা নিশ্চয়ই জানেন না পম্পাদির একটা সুন্দর একতলা বাড়ি আছে, এই সোশ্যাল মিডিয়ার ইনকাম আর বরের ইনকাম ছাড়াও আরেকটা ইনকমের সোর্স আছে। তাই না দিদি?”
পম্পার গলার কাছটা তখন যেন কেউ টিপে ধরেছে, শরীরের একটা একটা অঙ্গ যেন অবশ হয়ে আসছে। পম্পা উত্তর দিতে পারলো না দেখে সৌমী আবার বললো, “ঠিক এরকমই আমার ফিল হয়েছিল পরশুদিন, যখন বরের সাথে অশান্তি চরমে উঠেছিল। এত অভাব আমি আর নিতে পারিনি, আসলে তোমার মতন এতো ইনকাম সোর্স আমাদের ছিল না। সৌরভ বাড়ি ঢুকতেই আমি ঝগড়া করা শুরু করে দিই, আর তারপর.... মশারী টাঙ্গানোর দড়ি দিয়ে গলাটায় ফাঁস দিয়েছিল আমার। আগেরদিনই অবশ্য বলেছিল বেশি ঝগড়া করলে আমাকে প্রাণে মেরে ফেলবে, কিন্তু আমি বিশ্বাস করিনি। কেন করিনি জানো? কারণ আমার আদর্শ ছিলো তুমি আর তোমার বর। আমি ভেবেছিলাম সব বরেরা তোমার বরের মতনই হয়। জানো ও আমার জন্য একটা কোল্ড ড্রিংক্সের বোতল নিয়ে এসেছিলো, যেটা আমি আর খাওয়ার সময় পায়নি। তবে আমাকে মারার পরে ও কিছুক্ষণের জন্য পাগল হয়ে গেছিল, কোল্ড ড্রিংক্সটা আমার গলায় ঢেলে দিয়েছিল। দমবন্ধ হওয়ার পরে ঠান্ডা পানীয়র টেস্ট কেমন লাগে সেটা তোমাকে তো একটু আগেই বুঝেছিলাম!”
একটু থেমে পম্পার দম আটকে উঠে প্রায় নিস্তেজ হয়ে আসা শরীরটার দিকে তাকিয়ে আবার বললো, “হ্যাঁ ঠিক এরকমই মনে হচ্ছিলো.. হ্যাঁ একদম এইভাবেই আমার নিশ্বাসটা আটকে আসছিল। তবে বেশিক্ষণ না, একটু পরেই আর নিশ্বাস নেওয়ার দরকার পরবে না দেখো দিদি!”
সৌমীর বলে যাওয়া প্রত্যেকটা কথার সাথে পম্পার গলায় যেন চাপ বাড়াচ্ছিল অদৃশ্য দড়িটা, আর সেকেন্ড পাঁচেকের মধ্যেই সৌমীর কথা মিলে গেল। পম্পার আর নিশ্বাস নেওয়ার দরকার পড়লো না।